বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু: মিথ ও বাস্তবতা

পদ্মা সেতু নিয়ে কিছু ভুল ও অতিরঞ্জিত তথ্য মূলধারার গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের মাধ্যমে ছড়িয়েছে।

বিশ্বব্যাংক ও পদ্মা সেতু: মিথ ও বাস্তবতা

সর্বশেষ স্প্যান সংযোজনের মধ্য দিয়ে অবশেষে পদ্মা সেতুর কাঠামো নদীর দুই তীরকে একত্রিত করেছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের বদৌলতে এই সেতুর প্রতিটি স্প্যান সংযোজনের খবর মানুষের কাছে পৌঁছেছে। উইকিপিডিয়ায় “পদ্মা সেতু” নিবন্ধে “স্প্যান বসানোর সময়ক্রম” শীর্ষক একটি অংশও রয়েছে, যেখানে প্রতিটি স্প্যান বসানোর দিন ও তারিখের বিবরণ রয়েছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প। এই বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নকে তাই এক ধরনের অর্জন হিসেবে দেখা হচ্ছে।

এই সেতুর প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব নিয়েও কোনো সংশয় বা দ্বিমত নেই। তবে এই সেতু নিয়ে কিছু ভুল ও অতিরঞ্জিত তথ্য মূলধারার গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যের মাধ্যমে ছড়িয়েছে আর অনেক মানুষ সেগুলো বিশ্বাস করছেন।

এছাড়া শুরু থেকেই এই প্রকল্পকে ঘিরে ছিল বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক। বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থায়নের কথা থাকলেও, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে প্রকল্প থেকে সরে আসে। এই ঘটনায় বাংলাদেশের তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদত্যাগ করতে হয়। সরে দাঁড়াতে হয় অর্থ উপদেষ্টা মশিউর রহমানকে। কারাগারে যেতে হয় সেতু সচিবকে।

পরবর্তীতে অবশ্য বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পুত্র ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী এবং শাসক দল আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেন, এই পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতির ঘটনা ঘটেনি। পরে তো এও দাবি করা হয় যে, কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়েছে যে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এই অর্থায়নের ঘোষণা আসার পরই মোবাইল ফোনে কথোপকথনের ওপর অতিরিক্ত সারচার্জ আরোপ করা হয়, যদিও সরাসরি সরকার বলেনি এই সারচার্জের অর্থ পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় হবে। পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবিশেষের ধারাবাহিক আক্রমণ একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ করেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী বাংলাদেশি অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনুস এক্ষেত্রে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বকে ব্যবহার করে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত করাকে প্রভাবিত করেছেন।

এই রাজনৈতিক ডামাডোলে সরকারের পদ্মা সেতু প্রকল্প যেন আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের প্রতিরোধের আখ্যানে পরিণত হয়। তাই শেষমেশ পদ্মা সেতু বাংলাদেশের অবকাঠামোগত অর্জনের চেয়ে অনেক বেশি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিজয়ে রূপান্তরিত হয়। যে প্রকল্পটি হতে পারত আওয়ামী লীগের জন্য একটি কলঙ্কিত অধ্যায়, সেটিকেই এখন দলটির এক মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। পদ্মা সেতু হয়ে উঠেছে মিথের সমতুল্য। এই অধ্যায় এখন যেন দলটির প্রচার-প্রচারণার সামর্থ্যেরও ইঙ্গিতবাহী।

তবে পদ্মা সেতু বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া বহু দাবি ছিল অসত্য, অর্ধসত্য, প্রমাণহীন ও বিভ্রান্তিকর। বাংলাদেশ সরকারের মুহুর্মুহ রাজনৈতিক আক্রমণের মুখে খোদ বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের ওয়েবসাইটে “ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চন্স” অংশে প্রশ্নোত্তর আকারে অনেক সমালোচনারই জবাব দিয়েছিল। কেউ চাইলে সংযুক্ত লিংকটিতে গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন।

কিন্তু বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমে এই দিকটি সমান গুরুত্ব পায়নি। আওয়ামী লীগ ও সরকারের সেইসব দাবিগুলো নিয়েই পদ্মা-সেতুর সর্বশেষ স্প্যান সংযোগের পরিপ্রেক্ষেতে এই ফ্যাক্টচেক।

১. “বিশ্বব্যাংক সরকারের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেনি”

২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংকের একটি বিবৃতিতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ধরন সম্পর্কে বর্ণনা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, “বিশ্বব্যাংকের কাছে বেশকিছু বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে (যা একাধিক সূত্রের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করা হয়েছে) যা থেকে ইঙ্গিত মিলে যে, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশি সরকারি কর্মকর্তা, এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা এবং কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষের যোগসাজশে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে।” সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই অভিযোগের পক্ষে বিশ্বব্যাংক কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেও প্রধানমন্ত্রী হাসিনা চট্টগ্রামের একটি অনুষ্ঠানে বলেন, “মাঝামাঝি সময়ে এসে তারা [বিশ্বব্যাংক] একটি অভিযোগ আনল যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে। তখনও কোনো টাকা ছাড় হয়নি, কিছু নাই, দুর্নীতিটা হলো কোথায়? যখন এ প্রশ্ন করা হলো, তখন উত্তর দিতে পারে না।”

প্রথমত, টাকা ছাড় হয়নি বলে দুর্নীতি হতে পারে না, বিষয়টি তা নয়। দুর্নীতি কেবল অর্থ লেনদেনকেই বোঝায় না। অর্থ লেনদেনের পরিকল্পনা করাও দুর্নীতি। বিশ্বব্যাংকের মূল অভিযোগ ছিল এটিই; অর্থাৎ ঘুষ লেনদেনের “ষড়যন্ত্র” করা।

এছাড়া বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, “২০১১ সালের সেপ্টেম্বর ও ২০১২ সালের এপ্রিলে আমরা দুইটি তদন্ত প্রতিবেদন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে প্রদান করি। আমরা বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো পুরোপুরি তদন্ত করার আহ্ববান জানাই। পাশাপাশি, যৌক্তিক ক্ষেত্রে দুর্নীতির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আহ্ববান জানাই।”

অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাবি অনুযায়ী “বিশ্বব্যাংক সরকারের প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি”, এ কথা সত্য নয়।

২. “কানাডার আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়নি”

বিশ্বব্যাংক মূলত তিনটি পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে: ক) বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাবৃন্দ; খ) এসএনসি লাভালিন; এবং গ) কয়েকজন ব্যক্তিবিশেষ। এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে ঘুষ দেওয়ার, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার ষড়যন্ত্র আর বাকিদের বিরুদ্ধে বিষয়টির মধ্যস্থতা করার অভিযোগ উঠেছে। এখানে এসএনসি লাভালিন হলো কানাডিয়ান প্রতিষ্ঠান।

কানাডার আইন অনুযায়ী, দেশটির কোনো প্রতিষ্ঠান দেশে তো নয়ই, বিদেশেও চুক্তি পেতে ঘুষ দিতে পারবে না। এই কারণে দেশটির কৌঁসুলিরা এসএনসি লাভালিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন। এছাড়া মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তিবিশেষের মধ্যে এক জন ছিলেন কানাডিয়ান।

এসএনসি লাভালিনের দুই কর্মকর্তা ও মধ্যস্থতাকারী এক কানাডিয়ানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে কানাডা কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ, বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যেই অভিযোগ, সেটি এই তদন্তের আওতাতেই ছিল না। ফলে এই তদন্তের ভিত্তিতে বলা যায় না, বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এদিকটা ফয়সালা করার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের। এই বিষয়ে দুদকের দায়ের করা একটি মামলায় তৎকালীন সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে জেলে যেতে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত দুদক ঘোষণা দেয়, অভিযোগের কোনো প্রমাণ তারা পায়নি। পরে মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া চাকরি ফিরে পান। পরবর্তীতে তিনি এনবিআর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত।

দ্বিতীয়ত, এসএনসি লাভালিন ও ওই কানাডিয়ান নাগরিকের বিরুদ্ধে করা মামলাটি মূলত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সেখানেও আসলে ওই অর্থে বিচার বা ট্রায়াল হয়নি।

কানাডায় দায়ের মামলায় দুর্নীতির প্রধান প্রমাণ ছিল আড়িপাতা ফোনালাপ। কিন্তু আদালত রায় দেয়, এই ফোনালাপ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। কারণ ফোনে আড়িপাতার অনুমতি গ্রহণের জন্য পুলিশ যে কারণ দেখিয়ে ছিল, তা যথোপযুক্ত ছিল না। অতএব, ওই কারণের ভিত্তিতে অনুমতি নেওয়ায় আড়িপাতা ফোনালাপ প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনযোগ্য নয়। এরপরই কৌঁসুলিরা সিদ্ধান্ত নেন, যেহেতু প্রধান প্রমাণই উপস্থাপন করা যাবে না, তাই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারার সম্ভাবনা একেবারেই কম। তাই কৌঁসুলিরা অভিযোগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দেন। অর্থাৎ, এর মানে এই নয় যে দুর্নীতি না হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।

৩. “কানাডার আদালত বলেছে, দুর্নীতির অভিযোগ ছিল ‘গুজব ও শোনা কথা’”

কানাডার দুর্নীতির মামলাটি প্রত্যাহারের পর, বাংলাদেশের শাসক দলের নেতারা বিষয়টি লুফে নেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সংসদ অধিবেশনে এই কারণে বিশ্বব্যাংকের কড়া সমালোচনা করেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংসদে বলেন, “এই মামলাটি দায়ের করা হয় বানানো গল্প ও গুজবের ভিত্তিতে।”

প্রধানমন্ত্রীর পুত্র ও তার উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেন, “[কানাডার] আদালত বলেছেন যে, প্রমাণটি মূলত ছিল ‘গুজব ও শোনা কথা’র ভিত্তিতে। অন্যভাবে বললে, এটি ছিল বানানো।”

ওই সময় প্রকাশিত বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে বলা হয়, “আদালত এও বলেছে, অভিযোগটি অনুমান ভিত্তিক, গুজব এবং জনশ্রুতি ছাড়া আর কিছু নয়।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক জনসভায় বলেন, “বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির অভিযোগ আনল, তখন আমি চ্যালেঞ্জ দিলাম, আমরা দুর্নীতি করিনি, পারলে প্রমাণ করো। আল্লাহর রহমতে প্রমাণ করতে পারেনি। কানাডার ফেডারেল কোর্ট যেখানে মামলা করেছিল, তারা বলে দিয়েছে, এখানে কোনো দুর্নীতি হয়নি। আমি কথা দিয়েছিলাম, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবো। আপনাদের দোয়ায় সেই পদ্মা সেতু নিজেদের অর্থায়নে করে যাচ্ছি।”

১১ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখে ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এক নিবন্ধে লিখেন, “The bridge had been transformed into a national challenge when World Bank, ADB, JICA and IDB injudiciously and without much self-examination refused to extend fund due to ‘corruption intention’ charges that later proved unfounded.”

মাহফুজ আনাম লিখেছেন, বিশ্বব্যাংক “দুর্নীতির উদ্দেশ্য” ছিল বলে যেই অভিযোগে অর্থায়ন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল, তা পরবর্তীতে ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়।

কিন্তু বাস্তবে কানাডার আদালত বলেননি যে, দুর্নীতির অভিযোগটি অনুমান-ভিত্তিক বা গুজব। কানাডার একটি আদালতের বিচারপতি ইয়ান নর্ডহেইমার মূলত অভিযুক্তদের ফোনে আড়িপাতার অনুমতি লাভের জন্য পুলিশকে যে সব তথ্য দাখিল করতে হয় (যাকে বলা হয় আইওটি বা ইনফরমেশন টু অবটেইন) তা নিয়ে এই মন্তব্য করেছেন। কানাডার প্রথমসারির পত্রিকা দ্য স্টার এ বিষয়ে বিচারপতি নর্ডহেইমারের হুবহু মন্তব্য প্রকাশ করেছে। তিনি বলেছেন, “আইটিওতে যেসব তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে, তা অনুমান, গুজব ও শোনা কথার বেশি কিছু ছিল না। আর এই গুজব ও শোনা কথাকে সমর্থন দিতে সক্ষম এমন কোনো সরাসরি তথ্য ভিত্তিক প্রমাণ দেওয়া হয়নি বা তদন্ত করা হয়নি।”

দ্য স্টারের প্রতিবেদনের মূল অংশ: “Nordheimer had previously ruled that the RCMP officer who swore what is known as an Information to obtain (ITO) in 2011 to secure a wiretap of the accused men’s private communications had failed to provide verifiable information and used language that essentially ‘trick(ed)’ a different judge into signing off on it. ‘Reduced to its essentials, the information provided in the ITO was nothing more than speculation, gossip and rumour,’ Nordheimer wrote. ‘Nothing that could fairly be referred to as direct factual evidence, to support the rumour and speculation, was provided or investigated.’”

অর্থাৎ ওই আইওটির ভিত্তিতে কানাডার পুলিশ অভিযুক্তদের ফোনে আড়িপাতার অনুমোদন পায়। আর আড়িপেতেই তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রমাণ সংগ্রহ করে পুলিশ। কিন্তু আইওটি নিয়েই যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে, তাই পুলিশের আড়িপাতার বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। সেই কারণে আড়িপেতে সংগ্রহ করা প্রমাণ উপস্থাপনযোগ্য (বা আইনের ভাষায় অ্যাডমিসিবল) নয় বলে জানান আদালত। এরপরই মূলত রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিরা এই মামলা নিয়ে আর না আগানোর সিদ্ধান্ত নেন।

অর্থাৎ, আদালত কোনো ক্রমেই দুর্নীতির মূল অভিযোগকে “গুজব বা শোনা কথা” বলেননি।

৪. “বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ শাসক দলের অনেক নেতাই দাবি করেছেন যে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো ভিত্তি ছিল না। যেমন, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনা দাবি করেন, “আমি তাদের চ্যালেঞ্জ দিলাম, কোথায় দুর্নীতি হয়েছে সেটা প্রমাণ করতে হবে। …আপনারা শুনলে একটু অবাক হবেন, সাদা কাগজে একটা চিরকুট। এখান থেকে অমুক পাবে এত পারসেন্ট, অমুক এত পারসেন্ট। … এভাবে নানা অপপ্রচার শুরু হয়।”

এখানে যেই চিরকুটের কথা দাবি করা হয়েছে, সেটির কথা বিশ্বব্যাংকের নিয়োগ দেওয়া উচ্চ পর্যায়ের বহিঃআন্তর্জাতিক তদন্ত দলের মূল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে এক চিঠিতে বিশ্বব্যাংক এসএনসি লাভালিনের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী (যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন), আমলাদের একাধিক বৈঠকের ফিরিস্তি প্রকাশ করে। সেখানে ২০১১ সালের মে মাসে হওয়া একটি বৈঠকের উল্লেখ ছিল। লাভালিনের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের আমলাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে একটি নোটে লিখেছিলেন, “পদ্মা পিসিসি … ৪% মন্ত্রী … ১% সচিব।” বিশ্বব্যাংকের মতে এটিই ছিল ঘুষ দেওয়ার হিসাবনিকাশ। ওই বৈঠকের কয়েক সপ্তাহ পর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন দাখিল করে, যেখানে পরামর্শক পদে এসএনসি লাভালিনের নাম প্রস্তাব করা হয়। অথচ তখনও এসএনসি লাভালিন প্রয়োজনীয় তথ্যাদি পর্যন্ত দাখিল করেনি।

তবে এই তথ্য হয়ত কারও বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ প্রমাণ করার মতো পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু অন্তত একটি দুর্নীতির ষড়যন্ত্র হয়েছে, এমনটা দাবি করার মতো পর্যাপ্ত ভিত্তি এই তথ্যে আছে।

৫. “বিশ্বব্যাংকের কাছে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ নেই”

এটিও সরকার ও আওয়ামী লীগ থেকে বারবার করা একটি দাবি। কিন্তু বিশ্বব্যাংকও বলেছে, দুর্নীতির বিভিন্ন প্রমাণ তারা সরবরাহ করেছিল। অভিযোগ গঠন ও অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনাতা ছিল বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সরকার ওই দায়িত্ব তো পালন করেইনি, বরং অনেকটা অভিযুক্তদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে সরকার দাবি করেছে, কোনো দুর্নীতি হয়নি।

বিশ্বব্যাংকের কাছে ঠিক কী প্রমাণ ছিল তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে এই প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক এসএনসি লাভালিনকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করে। এই নিষিদ্ধ করার বিষয়টি দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতার (নেগোশিয়েটেড রেস্যুলেশন সেটলমেন্ট) অংশ। এই ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে অভিযুক্ত কর্তৃপক্ষ দোষ স্বীকার করেছে কিনা তা সবার প্রথমে বিবেচনায় নেয় বিশ্বব্যাংক। এছাড়া ভবিষ্যতে যেন দুর্নীতি না হয় সেজন্য অভিযুক্ত পক্ষকে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার করতে হয়। অর্থাৎ কোনো না কোনোভাবে অভিযুক্ত পক্ষকে দায় স্বীকার করতেই হয়।

এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, বিশ্বব্যাংকের হাতে থাকা প্রমাণগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী। তা না হলে এসএনসি লাভালিন এই সমঝোতায় সম্মত হতো না। বরং, সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ নিত কোম্পানিটি।

৬. “নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু”

পদ্মা সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিরোধ গাঁথার একটি বড় উপাদান হলো নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের দাবি। কোনো বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াই, স্ব-অর্থায়নে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সামর্থ্য ও সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে দেখান হয়। এই বছরের মার্চে শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা, সম্পূর্ণ বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে এই সেতু নির্মাণ করছি। আমরা যে নিজস্ব অর্থায়নে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারি এই আত্মবিশ্বাসটা আমাদের আছে। এটা ছিল আমাদের একটা বড় আত্মসম্মানের ব্যাপার।”

তার এই বক্তব্য মোটামুটি সত্য; কিন্তু পুরোপুরি সত্য নয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রকল্পের প্রাক্বলিত ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকা। এই ব্যয় এখন এসে দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়। এই অর্থ সরকার বার্ষিক বাজেট সমন্বয় করে ও রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে সরবরাহ করেছে। অর্থাৎ, এই বক্তব্য সত্য যে এই প্রকল্পে ব্যয় হওয়া অর্থ (৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা) সরকারি বাজেটের।

কিন্তু এটি ঠিক সরকারি-অর্থায়নের প্রকল্প নয়। সরকারি অর্থায়নের প্রকল্পে সাধারণত সরকার অর্থায়ন করে; কিন্তু পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয় এই ৩০ হাজার কোটি টাকা সেতু বিভাগকে ঋণ হিসেবে দিয়েছে। এই অর্থ (৩০০ কোটি টাকার অনুদান বাদে) সেতু বিভাগকে ১% সুদসহ অর্থ বিভাগকে ৩৫ বছরে ফেরত দিতে হবে

সেতু বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়কে এই অর্থ ফেরত দেবে কীভাবে? অর্থ ফেরত দেওয়া হবে টোল আদায়ের মাধ্যমে। এজন্য উচ্চমাপের সম্ভাব্য টোল হার ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে শেয়ারবিজ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, “বর্তমানে ফেরিতে একটি বড় বাসের পদ্মা নদী পার হতে লাগে এক হাজার ৫৮০ টাকা। পদ্মা সেতু হলে টোল দিতে হবে দুই হাজার ৩৭০ টাকা। আর বঙ্গবন্ধু সেতু পার হওয়ার জন্য বড় বাসের টোল ৯০০ টাকা।”

অর্থাৎ, এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পদ্মা সেতুর জন্য জনগণকে অনেকটা দুই দফায় টাকা গুনতে হবে। জনগণের করের অর্থে সেতু বিভাগকে ঋণ দেওয়া হবে। সেই ঋণ পরিশোধের জন্য আবার জনগণের কাছ থেকেই উচ্চহারে টোল নেওয়া হবে।

অর্থায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে সেতুর ব্যয় সংশোধন হয়। তখন ব্যয় দ্বিগুণ হয়ে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ব্যয় বৃদ্ধির একটি কারণ ছিল নকশা সংশোধন করে সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করা। এই রেলপথ পদ্মা সেতুর মূল প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু তারপরও এই রেলপথের কারণে মূল সেতু প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে। আবার রেলপথের সামগ্রিক ব্যয় প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ সেতু নির্মাণের চেয়েও ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। পদ্মা ব্রিজ রেল লিংক প্রজেক্ট নামে এই প্রকল্পের ৮৫% ঋণ হিসেবে আসার কথা চীন থেকে।●

নেত্র নিউজ-এর ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক ডেভিড বার্গম্যান ২০১৭ সালে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়্যারে এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। নিবন্ধটিতে পদ্মা সেতু দুর্নীতি কেলেঙ্কারির নানা বিষয় নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন — আগ্রহী পাঠকরা নিবন্ধটি পড়তে পারেন