ডেড রেকনিং: ফিরে দেখা

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বই “ডেড রেকনিং”। প্রকাশের পর বইটি নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছিল — তাই নিয়ে লিখছেন বইটির লেখক।

ডেড রেকনিং: ফিরে দেখা
১৯৭১ সালে এক দল মুক্তিযোদ্ধা। ফটো: ইন্টারফোটো/আলামি

আমার বই “ডেড রেকনিং: মেমরিস অফ দ্য নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার” প্রকাশের পর পেরিয়ে গেছে দশটি বছর। এই সময়টির কথা ভাবলে আমার নিজের ভিতর এক ধরনের স্থির, সৌম্য বোধ তৈরি হয়। ১৯৭১ এর কয়েকটি নির্দিষ্ট ঘটনা খতিয়ে দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে এ বইয়ের কাজ শুরু হয়েছিল। আমি আশা করেছিলাম, এর ফলে প্রাপ্ত তথ্য ১৯৭১ বিষয়ক সামগ্রিক জ্ঞানকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করবে। আমার লক্ষ্য ছিল সংখ্যাতত্ত্বের পেছনের নামগুলো এবং সংঘাতের মানবিক দিকটি তুলে আনা। সেই লক্ষ্য পূরণ করতে পারায় আমি সন্তুষ্ট।

প্রথমে ভেবেছিলাম, গবেষণা করতে গিয়ে যা জানতে পারব, তা ধারাবাহিক নিবন্ধ আকারে পত্রিকায় প্রকাশ করা যাবে। কিন্তু কাজের পরিধি ও বিপুল ব্যাপ্তি বোঝার পর সে পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হয়। শেষ পর্যন্ত, আমার প্রাথমিক ধারনার চেয়ে অনেক বিশাল হয়ে দাঁড়ায় কাজটি। বিশাল হলেও আমার কাজ আসলে সামগ্রিক ইতিহাসের কেবল কিছু চিত্র তুলে এনেছে; এতো বড় প্রেক্ষাপটে কাজ করেও সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এর আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। আসলে কোনো একক ব্যক্তির পক্ষে এমন সর্বব্যাপী কাজ করাটা আসলে অসাধ্য।

আমার বই যখন প্রকাশিত হয়েছে, ততদিনে ১৯৭১ থেকে চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী এবং প্রত্যক্ষদর্শী এমন অনেকেরই আমি সাক্ষাৎকার নিয়েছি যারা বইয়ের কাজ চলাকালীন অবস্থাতেই পরলোক গমন করেছেন। তারপর আরও অনেকে পরপারে চলে গিয়েছেন এতদিনে। বইটির জন্য আমি যেসব ঘটনা নিয়ে কাজ করছিলাম, সেগুলোর প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেবার সময় যে অত্যন্ত সীমিত, সে বিষয়ে আমি সচেতন ছিলাম। স্মৃতি সবসময় নির্ভুল বা পরিপূর্ণ হয় না। স্মৃতিচারণে একজনের সঙ্গে আরেকজনের অমিল থাকতে পারে। তারপরও কিন্তু এই সাক্ষ্যগুলো মূল্যবান। বিশেষত যখন যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষ্য পাওয়া সম্ভব এবং অন্যান্য বর্ণনার সঙ্গে তাদের তুলনামূলক যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। আমার বইয়ের কাজটি বেশ কঠিন ছিল বিভিন্ন কারণেই। এবং এর জন্য টানা কয়েক বছর কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে। কিন্তু কাজটি করতে পেরেছিলাম বলে আমি খুব খুশি আর এর সামগ্রিক ফলাফল নিয়ে তৃপ্ত।

আমার কাজ যে অন্যায় আক্রমণের শিকার হতে পারে এবং কিছু লোক তা বিকৃত করার চেষ্টা চালাতে পারে বা নিজেদের স্বার্থে এর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলতে পারে, তা আমি প্রথম উপলব্ধি করি ২০০৫ সালে। ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডাকা একটি আলোচনা সভায় আমি আমার গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রথম উন্মুক্ত প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়ে বিষয়গুলো টের পাই। এই প্রেজেন্টেশনের সময়ও কিন্তু আমার গবেষণা শেষ হয়নি। কিছু আক্রমণ যে ধরনের আক্রোশের সঙ্গে করা হয়েছিল, তাতে আমি অবাক হয়েছিলাম। আবার কিছু স্বার্থান্বেষী সমালোচনা এসেছে অপ্রত্যাশিত কয়েকটি স্থান থেকে।

তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে আমাকে লক্ষ্য করে সমন্বিত আক্রমণ চালিয়েছে এবং গালি দিয়েছে মাত্র গুটিকয় মানুষ। আর এ ধরনের বিদ্বেষমূলক আচরণ এবং মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত খুব বেশি কিছু করতে পারে না। আমার পরিশ্রম আমি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের প্রভাবমুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করলে প্রশংসা ও স্বীকৃতি পাবো বলে আশা ছিল। কাউকে সুবিধা দেবার তাড়না বা কোনো কিছুর ভয় আমার অনুসন্ধানকে প্রভাবিত করেনি। ফলস্বরূপ অনেকের কাছ থেকে স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েছি। বই যখন প্রকাশ হয়েছে তখনও যেমন এই স্বীকৃতি আর প্রশংসা পেয়েছি; পরবর্তী এক দশক ধরেও তা পেয়ে এসেছি। যারা আমার বইয়ের সমাদর করেছেন, তারা সাধারণত ইন্টারনেটে নিজেদের মতামত বা প্রশংসা ছড়িয়ে বেড়াননা। কিন্তু যারা বিদ্বেষ ছড়াতে চান, তারা সেই ধরনের প্রচারে লিপ্ত থাকেন। এমনকি যারা বইটি পছন্দ করেছেন, তারাও অনেকেই জনসমক্ষে নিজেদের মত প্রকাশে ভীত ছিলেন। এই ভীতির পরিবেশ যে শুধু বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, তা নয়। যারা অন্যান্য দেশ থেকে বাংলাদেশে যেতে চান, তারাও এই ভেবে ভীত, সন্ত্রস্ত হয়েছেন যে বইটি নিয়ে তাদের সত্য মত প্রকাশের ফলে তারা বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা পাবেন বা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে তাদের একঘরে করে ফেলা হবে।

এখন বইটি পুনর্নিরীক্ষণ করলে মনে হয়, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় একটু ভিন্নভাবে আলোচনা করলে ভালো হতো। বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে আমি এ বিষয়গুলো সংশোধন করতে চাই। একটি প্রশ্ন হলো, যুদ্ধে মোট মৃত্যুর সম্ভাব্য একটি সংখ্যা আমার দেয়া উচিত ছিল কিনা এবং সেটা আমি কিসের ভিত্তিতে দিয়েছি। বইয়ে আমি লিখেছি যে প্রাপ্ত প্রমাণাদির বিচারে মোটামুটি আস্থার সঙ্গে অনুমান করা যায় যে মুক্তিযুদ্ধে কমপক্ষে ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ লোক নিহত হয়েছে। যদিও যুদ্ধে ১০০,০০০ এর বেশি মৃত্যু অসম্ভব নয়; কিন্তু এর বাইরে অনুমান করা অর্থহীন হয় ।

আমার এ দিকগুলো নিয়ে দুজন মানুষের কাছ থেকে আমি ন্যায্য সমালোচনা পেয়েছি। এদের একজন ডেভিড বার্গম্যান; যিনি লিখেছিলেন, “মৃতের সংখ্যা নিয়ে কোনো কিছু ‘আস্থার সঙ্গে অনুমান’ করাটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে তা বোধগম্য নয়। ১৯৭১ সালের কিছু ঘটনা কিভাবে দেখা হয়, তা নিয়েও বইয়ে কিছু যথাযথ প্রশ্ন উত্থিত হয়েছে। একথাও সত্য হওয়া সম্ভব (যেমনটি তিনি ইঙ্গিত করেছেন) যে মৃতের সংখ্যা বিভিন্ন স্থানে অতিরঞ্জিত হয়েছে, যেমন শাঁখারীপাড়া (১৯৭১ এর মার্চে হত্যাকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা) এবং চুকনগর (১৯৭১ এর মে মাসে হত্যাকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা), কিন্তু তিনি যা নিয়ে গবেষণা করেছেন তাতে তেমন কিছু নেই যার ভিত্তিতে তিনি মৃতের সংখ্যা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেন।’’

আরেকজন যিনি ন্যায্য সমালোচনা করেছেন তিনি হচ্ছেন, অধ্যাপক জেনিফার লিনিং। হার্ভার্ডে আমার বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, আমি যখন যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি যে মুক্তিযুদ্ধে মৃতের সংখ্যা ২৬,০০০ বলে পাকিস্তানের সরকারি হিসাব সঠিক হতে পারে না, কারণ তা বাস্তবতার নিরিখে অনেক কম এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদীদের দাবি করা ৩০ লাখ মৃত্যুও একই কারণে অনেক বেশি, তখন সেটুকু বলে কেন থেমে গেলাম না। কেন আমি মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুর এরকম অনুমান ভিত্তিক সংখ্যা দেবার প্রয়োজন বোধ করলাম?

আমি কেন মুক্তিযুদ্ধে মৃতের একটা আনুমানিক সংখ্যা উল্লেখ করেছি তা আসলে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা উচিত ছিল। সেই সঙ্গে এই অনুমানের পরিধি কতখানি এবং আমি কিভাবে এই সংখ্যা নির্ধারণ করলাম তাও ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন ছিল। আমি অধ্যাপক লিনিংকে বলেছি, অনুমান করার ঝুঁকি সত্ত্বেও আমি শুধুমাত্র “২৬,০০০ অতি কম এবং ৩০ লাখ অতি বেশি” বলে শেষ করে দিতে পারিনি। কারণ এ দুই সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য এত ব্যাপক যে পাঠক এ থেকে কোনো ধারনাই পাবে না যে আসলে মুক্তিযুদ্ধে কী পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছিল। কাজেই আমার নিজের গবেষণা অনুযায়ী এই সংখ্যা অন্তত কোন স্তরে পড়তে পারে তা পাঠককে জানানো আমার কর্তব্য ছিল। অন্তত বিশাল ব্যবধানটা কতখানি কমান যায়, সে চেষ্টা করা উচিত ছিল। তবে আমার আরও স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন ছিল যে ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ এর হিসাবটি ন্যূনতম মৃতের সংখ্যা নির্দেশ করে। অর্থাৎ মৃতের সংখ্যা এর কম হওয়া প্রায় অসম্ভব।

সবশেষে, আমি কী প্রক্রিয়ায় সংখ্যার এই পরিমাপ গণনা করেছি তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন ছিল বইয়ে। আমি যেসব ঘটনা খতিয়ে দেখেছি, সেগুলোতে মৃতের সংখ্যা এবং তার সঙ্গে অন্যান্য লিখিত সাক্ষ্য প্রমাণের মিলিত তুলনা থেকে বইয়ে আমি মৃতের সংখ্যা ৫০,০০০ থেকে ১০০,০০০ এর একটি হিসাব দিয়েছি। এসব লিখিত হিসাবের মাঝে ছিল বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য (বেশিরভাগ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত)। তবে এখনও যে অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা অজানা থাকতে পারে, তাও মনে রাখা দরকার। বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করলেও যে তা পুরোপুরি সন্তোষজনক হতো, তাও আমি দাবি করি না।

আরেকটি বিষয় যা আমার মনে হয় আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলে ভালো হতো, তা হলো “জেনোসাইড” শব্দটির ব্যবহার। আন্তর্জাতিক আইনে এই শব্দটির ব্যবহার পরিধি এবং ১৯৭১-এ কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যবহার কেন যথোচিত (যেমন শাসকদের দ্বারা হিন্দুদের বিশেষভাবে টার্গেট করা বা বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা “বিহারীদের” বিশেষভাবে টার্গেট করা)। অথচ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য আরও কিছু নৃশংসতার ক্ষেত্রে এই শব্দটি ব্যবহার করা বেশ মুশকিল, তা সে ঘটনাগুলো যত বর্বরোচিতই হোক না কেন।

এখানে ভুল বোঝাবুঝির একটা কারণ হচ্ছে অনেকেই “জেনোসাইড” বলতে “হত্যাযজ্ঞ” বা অনেক মানুষ হত্যা কিংবা কোনো ভয়াবহ নৃশংসতা বুঝে থাকে। জেনোসাইড কনভেনশনের সীমিত সংজ্ঞা অনুযায়ী এ শব্দটির ব্যাপ্তি সাধারণ মানুষ চিন্তা করে না। বইয়ে একথা আলোচনা করলে ভালো হতো যে কোনো নির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে “জেনোসাইড” শব্দটি ব্যবহার না করা গেলে তার মানে এই দাঁড়ায় না যে ওই হত্যাকাণ্ড জঘন্য অপরাধ ছিল না। কিংবা “যুদ্ধাপরাধ” ও “মানবতা বিরোধী অপরাধ” “জেনোসাইড” এর তুলনায় কম ঘৃণ্য।

আমার বই প্রকাশের বছরই আমি “জেনোসাইড” প্রশ্নের উপর জার্নাল অফ জেনোসাইড রিসার্চে একটি লেখা প্রকাশ করি। বইটিতে সে আলোচনাও যুক্ত করা গেলে ভালো হতো মনে হয়।

আমার বিরুদ্ধে আক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি জেনেও আমি আমার অনুসন্ধানে যা পেয়েছি, তা বইয়ে প্রকাশের জন্য বদ্ধপরিকর ছিলাম। কারণ আমি জানি যে আমার অনুসন্ধানের ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ গবেষকদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য সংরক্ষণ করা বিশেষ জরুরি ছিল। চাইলেও ভবিষ্যতে আর এ কাজ করা যাবে না। কারণ প্রত্যক্ষদর্শীরা তখন আর কেউ বেঁচে থাকবে না। আমি জানতাম, আমার বই সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে। আর এই বই প্রকাশের পর গত এক দশকেও আমার এই বিশ্বাসের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।●

শর্মিলা বসু — শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও আইনজীবী — “ডেড রেকনিং: মেমরিস অফ দা নাইনটিন সেভেন্টি ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার” গ্রন্থের লেখক।

এই বইটি নিয়ে অন্যদের রিভিউ/বিশ্লেষণ ও শর্মিলা বসুর জবাব:

Review by Martin Woollacott (Guardian)

It’s not the arithmetic of genocide that’s important. It’s that we pay attention (Ian Jack, Guardian)

This account of the Bangladesh war should not be seen as unbiased (Nayaneeka Mookhejee, Guardian)

Response by Bose to Mookherjee (Sarmila Bose, Guardian)

Flying Blind: Waiting for a Real Reckoning on 1971 (Naeem Mohaiemen, EPW)

“Dead Reckoning”: A Response (Response by Sarmila Bose, EPW)