মেগাপ্রকল্পের মেগাব্যয়

কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াবহ সংকটকালে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশে সাতটি মেগাপ্রকল্প বরাদ্দ পেয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। এই ৭টি প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল বাজেটের ৬%।

এই সাতটি প্রকল্প হলো:

১. রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র
২. পদ্মা সেতু
৩. মেট্রোরেল
৪. পদ্মাসেতুর রেল লিংক
৫. মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র
৬. পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর
৭. দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-ঘুমধুম সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক

এছাড়া দশটি মেগাপ্রকল্প বাজেটের ৯% বরাদ্দ পেয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছরে। এই প্রকল্পগুলো থেকে বাংলাদেশে এই বছর দুটি মেগাপ্রকল্প চালু হতে যাচ্ছে। প্রথমটি পদ্মা সেতু। দ্বিতীয়টি মেট্রোরেল। দুটো প্রকল্পই দীর্ঘ বিলম্ব, ব্যয় বৃদ্ধি ও সামাজিক-রাজনৈতিক জটিলতার মধ্য দিয়ে গেছে। বলাই বাহুল্য, উভয় প্রকল্পের ব্যয়ই অত্যন্ত বেশি। একটা পর্যায়ে বাংলাদেশের বাজেটের একটি বড় অংশ যাচ্ছিল এই দুইটি প্রকল্পের ব্যয় বহনের পেছনে। অর্থাৎ, এই ব্যয় জনগণকেই বহন করতে হয়েছে ও হচ্ছে। তাই  এই ব্যয় কতটুকু যৌক্তিক, তা জানার অধিকার জনগণের রয়েছে।

প্রথমেই পদ্মা সেতু — বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের দর্পের প্রতীক, বাংলাদেশের “গর্ব”, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “প্যাশন” প্রকল্প।

পদ্মা সেতুর খরচ ২০১৮ সালের হিসাব মোতাবেক ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকা, যা ৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান। এই খরচ প্রাক্বলিত খরচের তিন গুণ। সেই হিসাবে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতুর তালিকায় দশম। পদ্মা নদী অত্যন্ত খরস্রোতা।  পাশাপাশি, সেতুটি বহুমুখী সেতু — তাই এত খরচ পড়েছে বলে দাবি করা যেতে পারে। কিন্তু আসল চিত্র দেখতে বিশ্বের অন্যত্র তাকাতে হবে।

মুম্বাইয়ের সী-লিংক সেতু নদী নয়, সমুদ্রের উপর নির্মিত হয়েছে।  এই সেতুর মোট খরচ ২০১০ সালে পড়েছিল ১৬ বিলিয়ন রুপি। মুদ্রাস্ফীতি হিসাব করলে তা আজকের দিনে দাঁড়াবে ৩৮ বিলিয়ন রুপি, যা ৪৮৮.৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ, পদ্মা সেতুর ব্যয় এর সাত গুণ।

আসামের বগিবিল সেতু ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর উপর বানানো হয় ২০১৮ সালে। স্টিল-কংক্রিট ওয়েল্ডেড বিম ভারতে প্রথম ব্যবহৃত হয় এই সেতুতে, যাকে ভূমিকম্প-প্রতিরোধক বলা হয়। পানি নির্গমনের দিক থেকে আসামে ব্রহ্মপুত্র আর মাওয়ায় পদ্মা প্রায় কাছাকাছি। অথচ, এই সেতুর খরচ মাত্র ৭৮০ মিলিয়ন ডলার। বগিবিল সেতুর দৈর্ঘ্য ৪.৯৪ কিলোমিটার, পদ্মা সেতুর চাইতে সামান্য কম। দৈর্ঘ্য হিসাবে ধরলে একই উপাদানে বানানো বগিবিলের খরচ পড়ে ৯৭১ মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ পদ্মা সেতুর চারভাগের একভাগ প্রায়।

বিশ্বের নবম ব্যয়বহুল সেতু রাশিয়ার কের্চ প্রণালী সেতু, যেটি পদ্মা সেতুর মতোই বহুমুখী সেতু। রাশিয়ার ক্রাসনোডরের তামান পেনিনসুলা আর ক্রিমিয়ার কের্চ পেনিনসুলাকে সংযুক্ত করে নির্মিত হয়েছে এই সেতু। সাগরের উপর দিয়ে বানানো এই সেতু প্রায় একইরকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই বানানো হয়েছে বলে ধরা যায়। এই সেতুর দৈর্ঘ্য ১৮ কিলোমিটার — পদ্মাসেতুর তিন গুণ। এই সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার।

আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচকরা দাবি করেন, পদ্মা সেতু নির্মানে অর্থের অপচয় ও দুর্নীতির উপাদান ছিল অনেক বেশি। এই বিপুল অর্থব্যয় বহনের জন্য এখন বসানো হচ্ছে উচ্চ হারের টোল। এই টোল জনগণের উপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

আরেকটি বিতর্কিত মেগাপ্রকল্প হলো ঢাকার মেট্রোরেল। ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল থেকে যাওয়া এমআরটি লাইন-৬ ঢাকার বুক চিরে চলে গেছে। এর জন্য নগরবাসীর কোটি কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে। ঢাকাবাসীকে অসহনীয় যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছে, এখনও হচ্ছে।

এই মেট্রোরেলের দৈর্ঘ্য বিশ কিলোমিটার। প্রতি কিলোমিটারের ব্যয় হয়েছে ১০৯৪ কোটি টাকা। ভারতে এই ব্যয় ৪১৫ কোটি থেকে ৫০০ কোটি টাকা। ভিয়েতনামের ১৩ কিলোমিটার লম্বা হ্যানয় লাইনের খরচ পড়েছে ৬০৮ কোটি টাকা। সিঙ্গাপুরে পড়েছে ৫৮৯ কোটি টাকা। হো চি মিন সিটি লাইন-১ এর খরচ পড়েছে ৮৭৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্প্রতিক কালে তৈরি হওয়া সবচেয়ে ব্যয়বহুল মেট্রো রেল লাইন হলো ঢাকা এমআরটি লাইন-৬।

এমআরটি লাইন-৬ নির্মানের পর আরো দুইটি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে। এই প্রস্তাবিত দুইটি লাইনের নির্মাণ ব্যয় বর্তমান লাইনের চেয়েও প্রায় দ্বিগুণ — ১৮৩০ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটারের ব্যয়। এ প্রসঙ্গে সেই সময় এমআরটি লাইন-৬ এর প্রকল্প ডিরেক্টর মোহাম্মদ সায়েদুল হক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পদ্মাসেতু অথবা মেট্রোরেল কোনোটিই আসলে একেবারে পুরোপুরি নিজস্ব অর্থায়নে নয়। যেমন, পদ্মা সেতুকে রেলপথের সঙ্গে সংযোগ করার প্রকল্পের জন্য প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার — অর্থাৎ, প্রায় সেতু নির্মানের ব্যয়ের চেয়েও প্রায় ১০,০০০ কোটি টাকা বেশি — প্রয়োজন। আর এই অর্থের ৮৫% যোগান দিতে চীনের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। আবার ঢাকার মেট্রোরেলের অর্থায়নের ৭৩% এসেছে জাপানের জাইকার ঋণ থেকে। এসব প্রকল্পের এমন বিশাল ব্যয়ের ভার আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের নাগরিকদেরই বহন করতে হবে।●