ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হোক ছাত্রলীগমুক্ত

একটি রাজনৈতিক দলের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি তার ছাত্র সংগঠন। প্রায় ১৬ বছর ধরে মসনদে টিকে থাকার বদৌলতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের বড় একটি অংশকে দখল করে রেখেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। স্বল্প পরিশ্রমে অল্প বয়সে উজ্জ্বল ক্যারিয়ার, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আর বিলাসবহুল বেপরোয়া জীবনের হাতছানি উপেক্ষা না করতে পারা তরুণরা জড়িয়ে পড়েন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। বিসিএস ক্যাডার অথবা ছাত্রলীগের ক্যাডার হওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোন ভবিষ্যৎটা আছে?

সমাবেশ আর শো-ডাউন দিয়ে শুরু, তারপর পদ-পদবীর সিঁড়ি বেয়ে ছাত্রসমাজের সংগ্রামী বড় ভাইটি দামী গাড়িতে করে পৌঁছে যান গণভবনে। মাননীয়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেই আর পেছনে ফিরে দেখতে হয় না। রাষ্ট্রের আইন-কানুন, নিয়ম-নীতিকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে উড়ে বেড়ানোর এমন সুবর্ণ সুযোগের টোপ ফেলে আওয়ামী সরকার গঠন করেছে আওয়ামী মিলিশিয়া বাহিনী। রামদা-চাপাতি, হেলমেট, বাহারি বন্দুক — কী নেই এই বাহিনীর কাছে!

পুলিশ, র‍্যাব, ডিজিএফআই আর সামরিক বাহিনী থাকার পরেও একটি ছাত্র সংগঠনকে কেন মিলিশিয়া হিসেবে গড়ে তোলা হল?

বিশ্বজোড়া ছাত্র সংগঠনগুলোর কার্যক্রম দেখার পর ছাত্রলীগের দিকে তাকালে চমকে উঠতে হয়! খুন, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই যার সঙ্গে সংগঠনটির নাম আসেনি। জনসমক্ষে এত এত অপরাধ, অপকর্ম ঘটিয়েও কী করে সাফল্যের সঙ্গে সংগঠনটি টিকে আছে তা বুঝতে সাহায্য করবে দ্য ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন। বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত থাকার কারণে প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে জড়িত ছাত্রলীগ সদস্যদের পদ-পদবী ও সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হলেও পরবর্তীতে জনক্ষোভ কিছুটা মিইয়ে এলে লোকচক্ষুর আড়ালে তাদেরকেই পুরষ্কৃত করা হয়। আরও বড় পদ, আরও বড় উপহার, আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিছুদিনের ঝড়-ঝঞ্জা এভাবেই পুষিয়ে দেন বড় নেতা ও বড় ভাইয়েরা।

দৈনিক যুগান্তরে ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে পরবর্তী দশ বছরে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে এসেই ছাত্রলীগের হাতে ২৪ জন শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে প্রতিটি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অনুসন্ধান করলে সেই পরিসংখ্যানের ব্যাপ্তি কতটা ব্যপক ও বিস্তৃত হতে পারে তা যুগপৎ অনুমেয় ও অভূতপূর্ব বলেই ধারণা করি।

সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, গত ১৫ বছরে ছাত্রদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার যত আন্দোলন বা কর্মসূচি ছিল, ছাত্রলীগের কর্মীরা পুলিশের রক্ষা বেষ্টনীর মাঝে অবস্থান করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়নি বা তাদের পিটিয়ে আহত বা নিহত করেনি এমন কোন ঘটনার নজির পাওয়া যাবে না। যেন পুলিশ ও ছাত্রলীগ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অভিন্ন। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজে ব্যবহৃত না হয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো হয়ে উঠেছে আওয়ামী লীগের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন। অন্যদিকে ছাত্র সংগঠন থেকে ছাত্রলীগ পরিণত হয়েছে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনে — পুরো দেশ জুড়ে আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করার লাঠিয়াল তারা।   

প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন আওয়ামী লীগের রক্ষাকর্তা হিসেবেই কাজ করছে তখন ছাত্রলীগকে সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হল কেন?

কর্তৃত্ববাদী একনায়কতন্ত্র কায়েম হলে রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মধ্যে তফাৎ থাকে না। যাহা সরকার, তাহাই রাজনৈতিক দল। রাষ্ট্রীয় বাহিনী আর রাজনৈতিক মিলিশিয়ারা তখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মসনদ টেকানোর ঠিকাদার হিসেবে কাজ করে। নাৎসি জার্মানিতে হিটলার ইয়ুথ নামক সংগঠনটির কথা এক্ষেত্রে স্মর্তব্য। আওয়ামী বাংলাদেশে ওই হিটলার ইয়ুথেরই যেন পুনর্জন্ম হয়েছে ছাত্রলীগ নামে। ফুয়েরারের জার্মানি আর মাননীয়র বাংলাদেশের মধ্যে তফাৎ কমছে দিনে দিনে।        

কর্তৃত্ববাদের ইতিহাস, বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যত বিবেচনায় বর্তমানে যেকোনো রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেয়ে ছাত্রলীগ নামক মিলিশিয়া বাহিনীটি তাই বেশি ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশের আদালত স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারলে এই সংগঠনটি এতদিন আলো-ছায়ায় বেঁচে থাকার কথা ছিল না। আমরা ধরে নিতেই পারি এই সরকারের আমলে তাদের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে না। কিন্তু যদি কখনো সরকার পরিবর্তন হয়, কোনো জনবান্ধব রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে, তবে এই সংগঠনটির প্রতিটি সদস্যের কৃতকর্মের যেন বিচার হয়। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন বাস্তবতায় বিভীষিকা হয়ে বিরাজমান এই ছাত্র সংগঠনটিকে যেন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। সন্ত্রাসী সংগঠনটিকে আইন করে যেদিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে, সেই দিনটির দিকে আমরা তাকিয়ে আছি।●

সুরাইয়া সুলতানা (বীথি), প্রতিবেদক, নেত্র নিউজ।