বাংলার ওলীকুল শিরোমনি সুলতানে সিলেট হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.) মুসলিম বাংলার ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি ছিলেন মুসলিম বাংলার প্রথিকৃৎ ইসলাম প্রচারক শায়খুল মাশায়েখ বা পিরানে পীর তাকে এদেশের মুসলিম জাতিসত্তার আদি রূপকার বলে চিহিত করা হয়। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পীর-আউলিয়া নিজ ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ইসলামের সুমহান বাণী প্রচার করে উপমহাদেশে ইসলামের ভিত্তি মজবুত করেছেন। এই আত্মত্যাগী সাধকগণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় শুধু ধর্মপ্রচারই করেননি বরং অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় শাসকদের দুঃশাসন ও অনাচার থেকে জনগণকে রক্ষা করে মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। যেসব আউলিয়া পীর ও সাধক বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে অনবদ্য ভূমিকা রেখে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে প্রথমেই যার নামটি মনে আসে তিনিই উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফীসাধক হযরত শাহজালাল ইয়েমেনী (রহ.)।
বাংলাদেশ আসাম তথা বৃহত্তর বঙ্গ ইসলামের আলোকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে যাঁর নাম সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং এদেশের সূফি, দরবেশ, আউলিয়াগণের মাঝে যাঁর প্রভাব ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশী লক্ষ্য করা যায় তিনি হযরত শাহ্জালাল মুজার্রদ ইয়েমেনী রহমতুল্লাহি আলাইহি। এতদঞ্চল ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে জনসাধারণের মাঝে তাঁর প্রতি ভালবাসা ও নামের মাহাত্ম ব্যাপক ও অতুলনীয়। ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফি ও দরবেশ হযরত শেখ শাহজালাল মুজার্রাদ ইয়ামনী (রাহ.)। উনার পুরো নাম শেখ শাহ জালাল কুনিয়াত মুজাররাদ। ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টীয় সালে ৩২ বছর বয়সে ইসলাম ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে অধুনা বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। সিলেট আগমনের সময়কাল নিয়ে যদিও বিভিন্ন অভিমত রয়েছে তদুপরি হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর সমাধির খাদিমগণের প্রাপ্ত ফার্সি ভাষার একটি ফলক-লিপি থেকে উল্লেখিত সন-তারিখই সঠিক বলে ধরা হয়। ফার্সি ভাষায় লিখিত ফলক-লিপি বর্তমানে ঢাকা যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সিলেটে উনার মাধ্যমেই ইসলামের বহুল প্রচার ঘটে। সিলেট বিজয়ের পরে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর সঙ্গী-অনুসারীদের মধ্য হতে অনেক পীর-দরবেশ এবং তাদের পরে তাদের বংশধরগণ সিলেটসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বসবাস করেন।
হযরত শাহ জালাল (রাহ.) এর সফরসঙ্গী ৩৬০ জন আউলিয়ার সিলেট আগমন ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। হিজরী ষষ্ঠ শতকের শেষাংশে মক্কার কোরায়েশ বংশের একটি শাখা মক্কা শহর হতে হেজাজ ভূমির দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তে ইয়েমেন প্রদেশে গিয়ে বসবাস করেন। হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর পিতার নাম মুহাম্মদ বা মাহমুদ। উনার দাদার নাম ইব্রাহিম। হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর মাজারে প্রাপ্ত ফলক-লিপি সুহেলি ইয়ামনী অনুসারে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)৩২ বছর বয়সে ৭০৩ হিজরী মোতাবেক ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে সিলেট আগমন করেন। সুহেলি ইয়ামনীতে উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায় যে ৬৭১ হিজরী (১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে) হযরত শাহ জালাল (রাহ.) জন্মগ্রহণ করেছেন। উনার জন্মভূমি ছিল প্রাচীন আরবে আযমের হেজাজ ভূমির তৎকালীন প্রদেশ ইয়ামেন দেশের কুনিয়া নামক শহরে। হযরত শাহ জালাল (রাহ.) যখন তিন মাসের শিশুবালক তখনই উনার মাতার ইন্তেকাল হয়।
হযরত শাহ জালাল (রাহ.) শিশুকালেই মাতৃহীন হন এবং পাঁচ বছর বয়সে পিতাকে হারান। মামা আহমদ কবির তাকে দত্তক নেন। আহমদ কবির আরবী ভাষায় কোরআন-হাদিস শিক্ষা দেয়া সহ ইসলাম ধর্মের প্রাথমিক বিষয়ে (নামাজ, রোজায়) অভ্যস্ততার গুরুত্ব প্রদান করেন। পরবর্তিতে আহমদ কবীর হয়রত শাহ জালাল (রাহ.)কে ইয়েমেন থেকে মক্কায় নিয়ে যান। মক্কা শহরে আহমদ কবীরের একটি আস্তানা (হুজরা) ছিল। সেখানে অন্যান্য শিষ্যদের সাথে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)কেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন বলে জানা যায়। হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর মামা ও শিক্ষাগুরু শায়েখ সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দি সাধারণত আহমদ কবির নামে তিনি বহুল পরিচিত। সৈয়দ আহমদ কবিরের পিতার নাম সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী। সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী হযরত শাহ জালাল (রাহ.)জন্মগ্রহণ করার আগে ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারের লক্ষে মোলতানের নিকট আউচে এসে বসবাস করেন এবং সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দির পিতা সৈয়দ জালাল সুরুখ বোখারী ছিলেন তার পীর ও মুরশীদ।
হযরত শাহ জালাল (রাহ.)ভারতবর্ষে ধর্ম প্রচারের স্বপ্ন দেখার পরে সৈয়দ আহমদ কবির-এর কাছে ব্যক্ত করেন। মামা ও মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবিরকে তা জানান। আহমদ কবির এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা দিয়ে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)কে ভারতবর্ষে যাবার পরামর্শ দেন। যাত্রাকালে আহমদ কবির হযরত শাহ জালাল (রাহ.) এর হাতে এক মুঠো মাটি তুলে দিয়ে বললেন যে স্থানে এই মাটির স্বাদগ্ধ গন্ধগ্ধ ও বর্ণেরগ্ধ মিল এক হবে সেখানেই ধর্ম প্রচারের জন্য আস্তানা গড়বে। মুর্শিদ সৈয়দ আহমদ কবির (রাহ.)এর দোয়া নিয়ে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)ধর্মপ্রচার অভিযানে আরবের মক্কা শরিফ হতে একা-একাই যাত্রা শুরু করেন। নবী-রাসূল কিংবা অলী-আউলিয়াগণ প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনার অবতারণা করেছেন স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেসব ঘটনা একদমই অলৌকিক। নবী-রাসূলগণ যখন এ ধরনের ঘটনার অবতারণা করেন তখন তাকে বলে মুজিযা। একইরকম ঘটনার অবতারণা যখন কোনো অলী-আউলিয়া করেন তখন তাকে বলে কারামত। সিলেটের হযরত শাহজালাল (রাহ.)সম্পর্কেও বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত আছে। সেসব ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ফেরে। এগুলোর মাঝে কিছু কিছু গ্রন্থিত হয়ে বই আকারে প্রকাশও হয়েছে।
হযরত শাহ জালাল (রাহ.)মক্কা হতে বিদায় কালে যে কয়েক জন সঙ্গী উনার সাথে যাত্রা করেন তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হাজী ইউসুফ, হাজী খলীল, হাজী দরিয়া এবং আরেকজন সঙ্গী চাশনী পীর ছিলেন মৃত্তিকার তহবিলদার। হিন্দুস্থানে আসার পূর্ব পর্যন্ত সমরকন্দ থেকে সৈয়দ ওমর, রোম থেকে করিমদাদ, বাগদাদ থেকে নিজাম উদ্দীন, ইরান, জাকারিয়া ও শাহ দাউদ এবং সৈয়দ মুহম্মদ প্রমুখ তার অনুগামী হলেন। তাদের নিয়ে তিনি হিন্দুস্থানে প্রবেশ করলেন। এরপর পাঞ্জাবের মুলতান থেকে আরিফ, গুজরাট থেকে জুনায়েদ, আজমীর শরীফ থেকে মুহম্মদ শরীফ, দাক্ষিণাত্য থেকে সৈয়দ কাসিম, মধ্যপ্রদেশের হেলিম উদ্দীন প্রমুখ উনার মুরীদ হয়ে উনার সঙ্গে সঙ্গে চললেন। এভাবে দিল্লী পর্যন্ত এসে পৌঁছালেন তখন শিষ্যদের সংখ্যা ২৪০ জন বলে ধারণা পাওয়া যায়।
দিল্লিতে আসার পর হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ.)এর জনৈক শিষ্য গুরুর কাছে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর কুৎসা প্রচার করে। সঙ্গে সঙ্গে হযরত নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ.)অন্যের কুৎসা রটনাকারী এ শিষ্যকে উপযুক্ত শাস্তি স্বরূপ দরবার থেকে তাড়িয়ে দেন এবং অন্য দুই শিষ্যকে ডেকে তাদের মারফতে হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর কাছে সালাম পাঠান। হযরত শাহ জালাল (রাহ.)সালামের উত্তরে উপঢৌকনস্বরূপ ছোট একটি বাক্সে প্রজ্জলিত অঙ্গারের মধ্যে কিছু তুলা ভরে নিজামুদ্দীন আউলিয়ার নিকট পাঠান। নিজামুদ্দিন আউলিয়া হযরত শাহ জালাল (রাহ.)এর আধ্যাত্মিক শক্তির পরিচয় পেয়ে উনাকে সাদরে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। বিদায়কালে প্রীতির নিদর্শনস্বরূপ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ.)উনাকে এক জোড়া সুরমা রঙের কবুতর উপহার দেন। মাজার সংলগ্ন এলাকায় সুরমা রঙের যে কবুতর দেখা যায় তা ঐ কবুতরের বংশধর। যা জালালি কবুতর নামে খ্যাত।
ইতিহাসের মহান ব্যক্তিত্ব হজরত শাহজালাল (রাহ.)প্রসঙ্গে ইবনে বতুতা বলেন তিনিই শায়খ জালাল উদ্দিন তাবরিজী। এই শায়খ শ্রেষ্ঠ আউলিয়াদের অন্যতম শ্রেষ্ঠতম মানব তিনি। তার কারামত ছিল সুপ্রসিদ্ধ। আর তার কর্মকান্ডের উজ্জলতম নির্দেশনগুলোও বিশেষভাবে উল্লেখ যুগ্য। আমাদের কাছে শায়েখ নিজে বর্ণনা করেছেন যে খলিফা মুসতাসীম বিল্লাহ নিহত হওয়ার সময় তিনি বাগদাদে ছিলেন। তার সঙ্গীরা বলেছেন যে তিনি ১৫০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এই পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীরা তার কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এজন্য তাদের মধ্যে বাস করেছিলেন তিনি। বাংলাদেশে বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সাথে যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে আছে হযরত শাহজালালের (রাহ.)নাম। এক অনবদ্য সম্পর্ক মানুষ অনুভব করে তার সাথে। এই সম্পর্ক একইসাথে ভালোবাসার এবং শ্রদ্ধার। ইয়েমেনের লোককথায় এখনও পাওয়া যায় হযরত শাহজালালের (রাহ.)নাম। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হন এই বাংলার মাটিতেই। বাংলাদেশের প্রধান এবং সর্ববৃহৎ বিমান বন্দরটি তাঁর নামে। বাংলাদেশের সবচাইতে অগ্রসর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়টিও তাঁর নামে।
সিলেটের গণমানুষের কবি দিলাওয়ার রচিত একটি জনপ্রিয় গান আছে :
“তুমি রহমতের নদীয়া
দোয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া।
যেই দেশে আছিলা রসুল দয়ার পারাপার,
সেই দেশ হতে আইলায় তুমি রহমত আল্লাহর।
ছিলট ভূমি ধন্য হইলো তোমার পরশ পাইয়া,
দয়া করো মোরে হযরত শাহজালাল আউলিয়া।”
হযরত শাহজালাল (রহ.)এর মৃত্যুবরণের সঠিক তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। কিন্তু ইবনে বতুতার বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ১৫০ বছর বয়সে ৭৪৭ হিজরি ১৩৪৭ সালে ওফাত গ্রহণ করেন বলে জানা যায়। তিনি সিলেটেই সমাহিত হন এবং তাঁর সমাধিস্থল দরগা মহল্লা নামে পরিচিত। তাঁর বাৎসরিক ওরস আরবি জিলকদ মাসের ১৮, ১৯, ২০ তারিখ পর্যন্ত পালন হয়ে থাকে। সিলেটে হযরত শাহজালালের (রহ.)মাযারে রোজ হাজারো মানুষ আসেন শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। তাঁকে উসিলা হিসেবে ধরে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে আসে অগণিত মানুষ।
লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট