চট্টগ্রামে এলো দেশের সর্ববৃহৎ একক বিদেশি বিনিয়োগ, ৬৭০০ কোটি টাকার চমক!
লালদিয়ায় কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে ডেনমার্কের সঙ্গে চুক্তি
বন্দরের সক্ষমতা ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর এবং দ্বিগুণ বড় জাহাজ ভেড়ানোর ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরি করে চট্টগ্রাম বন্দরের লালদিয়ার চরে কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হলো।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ডেনমার্কের বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালসের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) চুক্তি সই হয়েছে, যা ইউরোপীয় কোনো দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বন্দর অবকাঠামো খাতে একক সর্ববৃহৎ প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ।
এই মেগা প্রকল্প চুক্তিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে জাতির জন্য একটি ‘বড় অবদান’ হিসেবে উল্লেখ করে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন আশা প্রকাশ করেছেন, যাদের মধ্যে এ নিয়ে সন্দেহ ছিল, আজ তা দূর হবে এবং এই ধারাবাহিকতায় মোংলা সমুদ্রবন্দর পরিচালনায়ও বিদেশি বিনিয়োগ আসবে।
এপিএম টার্মিনালসের মূল কোম্পানি মেয়ার্স্কের চেয়ারম্যান রবার্ট মেয়ার্স্ক উগলা জানিয়েছেন, লালদিয়া হবে অত্যাধুনিক গ্রিনফিল্ড টার্মিনাল, যেখানে নিরাপত্তা, অটোমেশন এবং স্থায়িত্বের সর্বোচ্চ মান বজায় থাকবে।
আনুষ্ঠানিক চুক্তি
চুক্তিতে সই করেন চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান এবং এপিএম টার্মিনালসের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টেইন ভ্যান ডোঙ্গেন। অনুষ্ঠানে ডেনমার্ক এবং বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন। ডেনমার্কের প্রতিনিধি দলে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ক স্টেট সেক্রেটারি লিনা গেন্ডলস হেনসেন এবং ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টিয়ান ব্রিক্স মুলার। বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, পিপিপি কর্তৃপক্ষ ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এবং প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী।
বিশাল বিনিয়োগের গুরুত্ব
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, লালদিয়া দেখিয়ে দিয়েছে পিপিপি শুধু তত্ত্বে নয়, বাস্তবেও কার্যকর। ভবিষ্যতেও তাঁরা বাস্তবায়ন-কেন্দ্রিক অবকাঠামো উন্নয়নেই মনোযোগ দেবেন। তিনি আরও জানান, আগামী কয়েক বছরে চারটি নতুন সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়নের কাজ চলছে, যার মধ্যে আছে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর, একটি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ও একটি নির্ধারিত মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল।
চুক্তি সই অনুষ্ঠান শেষে বিকেলে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ডেনিশ প্রতিনিধি দল। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি একটি নতুন যুগের সূচনা। এই বন্দর বাংলাদেশে বৃহৎ বিনিয়োগ ও পণ্যবৈচিত্র্যের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।
মেয়ার্স্কের চেয়ারম্যান রবার্ট মেয়ার্স্ক উগলা মন্তব্য করেন, এই প্রকল্প বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে এবং লজিস্টিকস খাতের অগ্রযাত্রায় এটি বিশেষ মুহূর্ত হয়ে থাকবে।
প্রায় সাত হাজার কোটির বিনিয়োগ
বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল হবে সম্পূর্ণভাবে এপিএম টার্মিনালসের নিজস্ব বিনিয়োগে একটি পিপিপি প্রকল্প। এই বিশ্বখ্যাত এপি মোলার-মেয়ার্স্ক গ্রুপের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটি সাইনিং মানি হিসেবে ২৫০ কোটি টাকা এবং নির্মাণকালে সব মিলিয়ে প্রায় ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। সরকার থেকে কোনো অর্থায়ন বা গ্যারান্টি প্রদান করা হচ্ছে না। টার্মিনাল নির্মাণ হলে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৮ লাখ টিইইউ ধারণক্ষমতা যুক্ত হবে, যা বর্তমান সক্ষমতার তুলনায় প্রায় ৪৪ শতাংশ বেশি।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক জানান, এই টার্মিনাল চালু হলে এখনকার তুলনায় দ্বিগুণ বড় কনটেইনার জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারবে এবং প্রতি ইউনিটে পণ্য পরিবহনের খরচ কমবে। ২০৩০ সালে টার্মিনাল চালু হলে এটি এদেশে বড় জাহাজ ভিড়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে এবং এতে ডেনিশ বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি এই অঞ্চলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। নির্মাণ ও পরিচালনা পর্যায়ে ৫০০ থেকে ৭০০ সরাসরি স্থানীয় কর্মসংস্থান এবং পরিবহন, লজিস্টিকস ও বৃহত্তর সাপ্লাই চেইনে হাজারের বেশি পরোক্ষ স্থানীয় কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এপিএম টার্মিনালের নিজস্ব ট্রেনিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে স্থানীয় প্রকৌশলী ও ব্যবস্থাপকরা বিশ্বমানের প্রশিক্ষণ পাবেন। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী, টার্মিনাল হ্যান্ডেল করা প্রত্যেকটি কনটেইনারের জন্য নির্দিষ্ট ফি পাবে সরকার এবং কনটেইনার হ্যান্ডেলিং বন্ধ থাকলেও সরকার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে অর্থ পাবে। নির্মাণের পর চুক্তির মেয়াদ হবে ৩০ বছর, যা সব শর্ত মেনে চললে বৃদ্ধি করা যাবে।
সিপি


