চট্টগ্রামে শীতের শুরুতেই ডেঙ্গুর নতুন ঢেউ, ২০ এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ ও ৫টি অতিঝুঁকিপূর্ণ
তিন মাসে আক্রান্ত বেড়েছে ৬৩ শতাংশ
চট্টগ্রামে শীতের সূচনালগ্নে ডেঙ্গুর প্রকোপ হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগ ও নাগরিকরা কপালে ভাঁজ পড়েছে। যেখানে সাধারণত বর্ষা পেরুলেই ডেঙ্গু আক্রান্ত কমে যাওয়ার কথা, সেখানে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে গড়ে ওঠা পরিস্থিতি অক্টোবর ও নভেম্বর ধরে রূপ নেয় এক ভয়াবহ ঢেউয়ে। একই তিন মাসে আক্রান্ত হয়েছে মোট আক্রান্তের ৬৩ শতাংশ। চট্টগ্রাম নগরের প্রধান হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন গড়ে একশো জ্বরের রোগী আসছেন এবং তাদের মধ্যে অন্তত ১০ থেকে ১৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। এই ধাঁচ গত তিন–চার বছর ধরে মিলেছে— এমন কথা জানিয়ে হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ে মৌসুমভিত্তিক ধারণা সম্পূর্ণ ভেঙে যাচ্ছে।
তিন মাসেই আক্রান্তের বড় অংশ
গত চার বছরের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৪ হাজার ৩৮৮ জন। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরে ৯৩৫ জন, অক্টোবরে ৯৯০ জন এবং নভেম্বরে ৮৮৩ জন আক্রান্ত হন; অর্থাৎ তিন মাসেই আক্রান্ত ২ হাজার ৩৮৮ জন, যা মোট আক্রান্তের ৬৩ শতাংশের সমান।
আগের বছরের একই সময়ের পরিসংখ্যানও উদ্বেগজনক: ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ৯০৭ জন, অক্টোবরে ১ হাজার ৪৩০ জন ও নভেম্বরে ১ হাজার ২৮ জন আক্রান্ত হয়; ওই বছর মোট আক্রান্ত ছিল ৪ হাজার ৩২৩ জন। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন ৩ হাজার ৮৯২ জন, অক্টোবরে ২ হাজার ৭৭৯ জন এবং নভেম্বরে ১ হাজার ২৫৪ জন; ওই বছর মোট আক্রান্ত ছিল ১৪ হাজার ৮৭ জন। ২০২২ সালে সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ছিলেন ৬০১ জন, অক্টোবরে ১ হাজার ৮৬১ জন এবং নভেম্বরে ২ হাজার ৭ জন; ওই বছর মোট আক্রান্ত হয়েছিল ৫ হাজার ৪৪৫ জন।
চলতি বছরে ডেঙ্গুজনিত মৃত্যুও হয়েছে; এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২৫ জন। ২০২৪ সালে মারা গিয়েছিলেন ৪৫ জন, ২০২৩ সালে ১০৭ জন এবং ২০২২ সালে ৪১ জন মারা গিয়েছিলেন।
নগরজুড়ে ২৫ এলাকা ঝুঁকিতে
শহর ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নির্ণয় সংক্রান্ত কাজও জোরদার করা হলেও সুফল পর্যাপ্ত নয়। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন মশা নিধন কার্যক্রম হিসেবে ক্রাশ প্রোগ্রাম, আবর্জনা পরিষ্কার, এডিস মশা নিধন ও লার্ভা ধ্বংসসহ বিভিন্ন অভিযান চালাচ্ছে; তবু প্রকোপ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। সিভিল সার্জন ও সিটি কর্পোরেশনের যৌথ জরিপে নগরের ২৫টি এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—বন্দর, কোতোয়ালী, কেপিজেড, হালিশহর, সদরঘাট, বাকলিয়া, বায়েজিদ, পাহাড়তলী, ডবলমুরিং, খুলশী, পাঁচলাইশ, আকবরশাহ, চকবাজার, চান্দগাঁও, পতেঙ্গা, আগ্রাবাদ, পাথরঘাটা, লালখানবাজার, আন্দরকিল্লা, কাট্টলী, দেওয়ানহাট, ২ নম্বর গেট, মুরাদপুর, চন্দনপুরা ও মোহাম্মদপুর।
এর মধ্যে বন্দর, কোতোয়ালী, কেপিজেড, হালিশহর ও সদরঘাটকে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনের সূত্র জানায়, এসব এলাকায় আবর্জনা ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, খোলা নালি ও নির্মাণকাজের কারণে পানির প্রসার এবং জমে থাকা জল এডিস মশার বৃদ্ধির প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে; ফলে ক্রাশ ও পরিচ্ছন্নতা অভিযান ব্যপকভাবে চালালেও মশার ঘনত্ব দ্রুত কমছে না।
বৃষ্টি প্যাটার্ন ও রোগীর চাপ
চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে ভিন্ন রকম বৃষ্টি প্যাটার্ন—বিশেষ করে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টি—এডিস মশার বিস্তারকে সহায়ক করেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বহির্বিভাগের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. এসএম রিয়াসাদ বলেন, বিষয়টি তাঁদেরকেও অবাক করছে। আগে ডেঙ্গু রোগী সাধারণত জুলাই-আগস্টের বর্ষা মৌসুমে বেশি আসতো। কিন্তু এখন প্রতিদিনই হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রায় শ’খানেক জ্বরের রোগী আসছেন এবং তাঁদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। অনেকে আবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েই হাসপাতালে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো কিছুটা ভিন্নভাবে প্রকাশ পাচ্ছে এবং আক্রান্ত হওয়ার পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যেই অনেকে তীব্র অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছেন, যা চিকিৎসার মাত্রা এবং রোগী ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলছে।
জ্বর হলেই পরীক্ষা করার পরামর্শ
চিকিৎসকরা রোগীদের জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন যে কোনো ধরনের জ্বর অনুভূত হলে সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে; প্রয়োজনে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। সিটি কর্পোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মসূচি থাকলেও চিকিৎসকেরা মনে করেন, জনগণকে দ্রুত সচেতন করা, ঢেউয়ের ধরন ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সম্পর্কে তথ্য বিতরণ এবং আবর্জনা-নিবারণ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কারের মতো কাঠামোগত কাজ দ্রুত না করলে পরিস্থিতি আরও গভীর রূপ নিতে পারে।
বর্ষার সীমানা পেরিয়ে দীর্ঘায়িত ডেঙ্গু
চট্টগ্রামের ডেঙ্গু পরিসংখ্যান ও মাঠ পর্যবেক্ষণ মিলে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এ রোগ এখন শুধু বর্ষাকালীন সমস্যা নয়; শহরের নির্মাণগত অরাজকতা, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ছন্দ ও অপর্যাপ্ত নিকাশি মিলে ডেঙ্গুকে দীর্ঘায়িত করার সুযোগ করে দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, চিকিৎসক ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমানো কঠিন হবে, বিশেষত যখন রোগের প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ক্রমশ বদলাচ্ছে এবং শীতের শুরুতেই রোগীদের হাসপাতালে যেতে হচ্ছে।
ডিজে


