ছাই থেকে হবে শক্ত ইট— চুয়েট ও লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্ভাবন
তৈরি হবে কয়লা বিদ্যুতের ১০ লাখ মেট্রিক টন ফ্লাই অ্যাশে
কাদামাটি ও সিমেন্ট ছাড়াই ইট তৈরি করে বাংলাদেশে টেকসই ইট তৈরির সূচনা করেছে একদল গবেষক। শিল্পবর্জ্য ও দূষণ কমানোর জন্য প্রচলিত ইটের বদলে এটি হবে চমৎকার বিকল্প। বিভিন্ন ধরনের শিল্পবর্জ্য থেকেই তৈরি হবে এই ইট। যৌথভাবে গবেষণাটি চালিয়েছে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুর্স বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও রিসার্চ ইংল্যান্ড এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), বিএসআরএম ও বড়পুকুরিয়া কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
গবেষণাটির মূল প্রবন্ধকার যুক্তরাজ্যের লিভারপুল জন মুর্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড. মনোয়ার সাদিক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম।
এ ছাড়া গবেষণাটি সহকারী হিসেবে চুয়েট থেকে প্রকৌশলী এসএম শাহরিয়ার সিফাত ও যুক্তরাজ্য থেকে ছিলেন প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ খাদিম ও হায়দার-আল-হাওয়েশ।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফ্লাই অ্যাশ এবং ইস্পাত শিল্পের নানা উপজাত ব্যবহার করেই পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ইট তৈরি করা সম্ভব। শুধু তাই নয়, জিওপলিমারাইজেশন পদ্ধতিতে পোড়ানো ছাড়াই সেই ইট তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অ্যালুমিনা এবং সিলিকা যখন অ্যালকালির সংস্পর্শে আসে তখন সেটি গলে যায়। আবার সোডিয়াম সিলিকেট সেখানে দিলে তাদের একটি চেইন আকারে বন্ডিং তৈরি হয়— যাকে বলা হয় জিওপলিমার। জিওপলিমার সিরামিকের মতো বৈশিষ্ট্যযুক্ত অজৈব উপাদান যা স্বাভাবিক বা সামান্য উচ্চ তাপমাত্রায় তৈরি করা যায়। তবে এর রাসায়নিক প্রক্রিয়া সাধারণ সিমেন্টের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যদিও সিমেন্টের শক্তি অর্জন মূলত ক্যালসিয়াম-সিলিকেট-হাইড্রেটস (C-S-H) গঠনের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু জিওপলিমার সাধারণত একটি ক্ষারযুক্ত দ্রবণের উপস্থিতিতে সিলিকা এবং অ্যালুমিনিয়া সমৃদ্ধ পদার্থের পলি কনডেনসেশনের ওপর নির্ভর করে।
গবেষকরা জানান, এটি কোনো নতুন থিওরি নয়। তবে এই জিওপলিমার ব্যবহার করে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে ইট তৈরির ঘটনাই বিরল। তাই আমরা এটি নিয়ে গবেষণা করছি।
গবেষকরা আরও জানান, অদূর ভবিষ্যতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস হবে— যেখানে ফ্লাই অ্যাশ তৈরি হচ্ছে। যেমন বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ২০০ মেট্রিক টন ফ্লাই অ্যাশ তৈরি হচ্ছে। এই অ্যাশ বা ছাই কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য দিন দিন খুবই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলাদেশে ফ্লাই অ্যাশ নিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে, যখন বর্তমান নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর (৩৮৪০ মেগাওয়ামের মাতারবাড়ী, বাঁশখালী, পায়রা ও রামপাল) নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়ে উৎপাদন শুরু করবে। বর্তমান হিসাবে বাড়তে থাকলে, ২০২৪ সালের পর থেকে ফ্লাই অ্যাশের বার্ষিক উৎপাদন ১০ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। এই বিপুল পরিমাণ ফ্লাই অ্যাশ জমে থাকলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। তবে পোড়ানো ছাড়া পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে যদি এই ফ্লাই অ্যাশ ব্যবহার করা যায়, তাহলে বড় একটি বিপদ থেকে দেশ বাঁচবে।
ফ্লাই অ্যাশই শুধু নয়, এছাড়া ইস্পাত শিল্প থেকে তৈরি হওয়া বিভিন্ন আকারের উপজাতগুলোকে ব্যবহার করেও ইট তৈরির কথা ভাবছেন গবেষকরা। এসব উপজাতের মধ্যে রয়েছে গ্রাউন্ড গ্রানুলেটেড ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ (GGBS), বৈদ্যুতিক আর্ক ফার্নেস স্ল্যাগ (EAFS) এবং বেসিক অক্সিজেন ফার্নেস স্ল্যাগ (BOFS) । বাংলাদেশের বেশিরভাগ ইস্পাত শিল্প ইনডাকশন চুল্লি ব্যবহার করে— যা প্রতি বছর আনুমানিক ৩২ লাখ টন ইস্পাত এবং সাত লাখ টন স্ল্যাগ উৎপাদন করে। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণে ইস্পাতের স্ল্যাগস উৎপাদিত হচ্ছে— যেগুলোকে জিওপলিমারাইজেশন পদ্ধতিতে ইট তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
ইংল্যান্ডের লিভারপুল জন মুর্স বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযু্ক্তি বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে গত তিন বছর ধরে গবেষণা করে এই শিল্পবর্জ্যগুলো ব্যবহার করে গবেষণাগারে রাসায়নিক জিওপলিমার পদ্ধতিতে প্রচলিত ইটভাটার ইটের বিকল্প হিসেবে অত্যন্ত উন্নতমানের ইট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জিএম সাদিকুল ইসলাম জানান, এই ইটের গুণগত মান বাংলাদেশের মান নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর নির্ধারিত মানের চেয়েও অনেক ভালো পাওয়া গেছে।
তিনি জানান, ইটভাটায় তৈরি ইটের প্রধান সমস্যা এর অতিরিক্ত (২০% পর্যন্ত) পানি শোষণ— যার ফলে দেয়াল সহজে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু গবেষণায় তৈরি বিকল্প ইটের পানি শোষণ সর্বোচ্চ ৭% পাওয়া গেছে। বর্তমানে গবেষকরা বাণিজ্যিকভাবে এই ইটের উৎপাদন শুরু করা হলে সেক্ষেত্রে খরচ কিভাবে কমিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। আশা করা যায়, খুব শিগগিরই দেশীয় প্রযু্ক্তিতে শিল্পবর্জ্য ব্যবহার করে অত্যন্ত উন্নতমানের রাসায়নিক ইট বাজারজাত করা সম্ভব হবে।
ড. সাদিকুল ইসলাম আরও জানান, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ও ইস্পাত মিলের বর্জ্য পদার্থগুলোকে রাসায়নিক ইট তৈরিতে ব্যবহার করা গেলে এই বিপজ্জনক বর্জ্যগুলো ব্যবস্থাপনার একটি সম্ভাব্য সমাধানও পাওয়া যাবে।
এই গবেষণা প্রবন্ধটি নিয়ে সোমবার (৫ জুলাই) একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। যার আয়োজক ছিল— আইসিই ইংল্যান্ডের বাংলাদেশ চ্যাপ্টার এবং চুয়েটের এসিআই স্টুডেন্ট চ্যাপ্টার। সেখানে অতিথি হিসেবে ছিলেন বিএসআরএমের হেড অফ ম্যানুফ্যাকচারিং প্রকৌশলী আজিজুল হক। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন বিএসআরএমের হেড অফ কোয়ালিটি প্রকৌশলী বিপিন কুমার শর্মা। সভাপতি হিসেবে ছিলেন আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলী আইসিই ইংল্যান্ড বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সভাপতি নাসিদ ইসলাম।
সিপি