জাইমার মান বাঁচাতে সেই ‘কালো আইন’ই ভরসা বিএনপির, ৪ মামলাই ডিজিটাল নিরাপত্তায়

0

‘বিএনপি শুরু থেকেই একটা সুবিধাবাদী অবস্থানে ছিল। এখন আবার তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছে। যেখানে তাদের দলীয় অবস্থান পুরোটাই এই আইনের বিরুদ্ধে, সেখানে এটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনি জাইমা রহমান সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগে সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসান এবং ফেসবুক লাইভের উপস্থাপক মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে চারটি মামলা নেওয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। চার মামলার আবেদনই করা হয়েছে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের পক্ষ থেকে। বিএনপি এতোদিন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘নিপীড়ন ও হয়রানির আইন’ বলে দাবি করে এই আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসলেও প্রথমবারের মত দলীয়ভাবে এই আইন ব্যবহার করে মামলা করলো তারা। ফলে বহুল সমালোচিত এই আইনের বিরোধিতা থেকে দলটি সরে আসলো কিনা কিংবা যে আইনকে এতদিন ধরে কালো আইন বলে আসছিল সে আইনে মামলার আবেদন করে বিএনপি এই আইনের বিরোধিতার নৈতিক অধিকার হারালো কিনা এসব প্রশ্ন উঠছে নতুন করে।

বিএনপির এমন সিদ্ধান্তে শুরু থেকে এই আইনের বিরুদ্ধে সরব থাকা সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীদের মধ্যেও দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। পাশাপাশি এই আইনে বিএনপির মামলার আবেদন সরকারকে নতুন পরীক্ষায় ফেলবে কিনা এমন প্রশ্নও উঠছে। তবে এই আইনের বিষয়ে পরীক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে সরকারের সদিচ্ছা জন্মানো নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করছেন বহুল বিতর্কিত আইনটির বিরুদ্ধে থাকা সচেতন নাগরিকরা।

তবে বিএনপি বলছে, বিশেষায়িত আইনের সুবিধা পেতে এবং এই আইনের ব্যবহারে সরকারের দ্বৈতনীতি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেই এই আইনে মামলা করেছে তারা। এক্ষেত্রে এই আইনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান আগের মতই থাকবে।

রোববার (১২ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন জানানোর পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
রোববার (১২ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন জানানোর পর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিএনপির পক্ষ থেকে মামলার আবেদন করায় হতাশা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘বিএনপি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছে কোন্ চিন্তা থেকে বুঝলাম না। যে আইনের বলি হাজার হাজার মানুষ— বাচ্চা থেকে গ্রামের কৃষক কেউ বাদ পড়েনি। যে আইনকে ভাগাড়ে ফেলার জন্য দীর্ঘদিন থেকে সবাই আন্দোলন করে আসছি। সেলুকাস!’

শুরু থেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিল বিএনপি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছাত্রদলের বিক্ষোভে নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সবশেষ গত ২০ অক্টোবরও এক বিবৃতিতে এই আইন বাতিলের দাবি জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি মনে করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার নীলনকশার অংশ। অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন বাতিল করতে হবে।’

তবে শুরু থেকেই বিএনপি এই আইনের বিষয়ে ‘সুবিধাবাদী’ অবস্থানে ছিল মন্তব্য করে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছেন, ‘বিএনপির এমন সিদ্ধান্তের কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে নাগরিক ও অধিকার কর্মীদের বিরোধের জায়গায় কোনো পরিবর্তন আসবে না।’

দীর্ঘদিন ধরে এই আইন বাতিলের দাবি করে আসা এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘এই ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান কখনোই জোরালো ছিল না।’ তবু এই আইনে মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত বিএনপির জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে বলে মনে করছেন এই আইনজীবী।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘বিএনপি আসলে জোরালোভাবে এটার বিরোধিতা করেছে, তা কখনোই ছিল না। বিএনপি শুরু থেকেই একটা সুবিধাবাদী অবস্থানে ছিল। এখন আবার তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করেছে। যেখানে তাদের দলীয় অবস্থান পুরোটাই এই আইনের বিরুদ্ধে, সেখানে আমি মনে করি এটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।’

তবে এতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সচেতন নাগরিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে না দাবি করে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘এই আইনের বিরুদ্ধে সিভিল সোসাইটির মুভমেন্টের সাথে বিএনপির খুব একটা সম্পর্ক ছিল না। যে যার যার জায়গা থেকে এটা নিয়ে কথা বলেছে। এখন কেউ যদি নিজের অবস্থান থেকে সরে আসে সেটা তাদের ব্যাপার। এর কারণে সিভিল সোসাইটির বিরোধিতার ক্ষেত্রে আমার মনে হয় না খুব একটা প্রভাব পড়বে।’

অন্যদিকে এই আইনে মামলা করার মধ্য দিয়ে বিএনপি এই আইনের ইস্যুতে নিজেদের আগের অবস্থান থেকে সড়ে এসেছে এমনটা মনে করেন না জানিয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার সারোয়ার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা আইনের অপব্যবহারের বিরোধিতা করেছি। এখন সেই আইনে মামলা করে আমরা ভুল করেছি— এমন কেন হবে? আইনটা যেহেতু বাতিল হয়নি সেহেতু এই বিষয়ে মামলা করতে এই আইনটি প্রাসঙ্গিক বলেই এই আইনে মামলা করা হয়েছে। মূল সমস্যাটা মিসইউজে। এখন কেউ যদি আইনকে খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে তাহলে তো আমরা সেটার বিরোধিতা করবো। সেক্ষেত্রে তো কোনো ব্যতিক্রম হবে না।’

বিতর্কিত এই আইন ব্যবহারের কারণ ব্যাখ্যা করে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রামের বর্তমান সভাপতি এ এস এম বদরুল আনোয়ার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা হচ্ছে স্পেশাল একটা আইন। যেমন ধরেন মানহানির জন্য পেনাল কোড আছে, আবার এই আইনেও মানহানি আছে। এখন অনলাইনে কেউ মানহানি করলে সেটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পড়ে। আইনের একটা প্রিন্সিপাল আছে একই অপরাধের জন্য সাধারণ আইনের পাশাপাশি যদি বিশেষায়িত একটা আইন থাকে তাহলে সাধারণ আইনের আগে আদালতও বিশেষায়িত আইনটা দেখে। এই কারণে বিশেষায়িত আইনের সুবিধা নিতে আমরা এই আইনে মামলা করেছি।’

তবে এক্ষেত্রেও বিএনপি নিজেদের অবস্থান থেকে সরে যাওয়ার প্রশ্ন উঠার সুযোগ নেই মন্তব্য করে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি বলেন, ‘আমরা তো আইনের অপব্যবহারের সমালোচনা করেছি। আইনের সমালোচনা করিনি। কোন আইনই খারাপ আইন নয়। তবে এটা দেখতে হবে অপব্যবহার হচ্ছে কিনা। যেহেতু যে কারণে এই মামলা এটা একটা বিশেষ অপরাধ এবং সেজন্য বিশেষ আইন আছে তাই আমরা ওই আইনে মামলা করেছি। তবে কেউ যদি এটা অপব্যবহার করে তার নিন্দাও আমরা সবসময় করবো।’

বিশেষায়িত আইনের সুবিধা পাওয়া ছাড়াও ডিজিটাল আইনে মামলা করার একটা রাজনৈতিক বিবেচনার কথাও উঠে আসে এই আইনজীবীর কথায়। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এ এস এম বদরুল আনোয়ার বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি কোনো ভাল উদ্দেশ্যে নয় বরং প্রতিপক্ষকে দমনের জন্য সরকার এই আইন করেছে। এই মামলার মাধ্যমে আমরা এটা দেখিয়ে দিতে চেয়েছি সরকার একটা আইনকে কিভাবে তার নিজের লোকদের জন্য ব্যবহার করছে আর তার বিপক্ষের জন্য সেই আইন কিভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারের যে দ্বৈতনীতি সেটা দেখানোই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের দ্বৈতনীতির বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘এর আগে ব্যারিস্টার মইনুল ইসলাম একটা কথা বলেছেন, তার জন্য কতগুলো মামলা হলো সারাদেশে। সরকার তো সেটাকে অ্যানকারেজ করেছে। একই অপরাধ যখন আরেকজন করলো তখন সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে? কদিন আগে সামশুজ্জামান দুদু ঢাকায় কী বলেছে তা নিয়ে রাঙ্গুনিয়ায় একটা মামলা হয়েছে। তখন কোনো কথা আসেনি। এখন কথা আসছে বিবাদী অন্য জায়গার বাসিন্দা। আগের মামলাগুলো দেয়ার সাথে সাথে হয়েছে। এখন কেন মামলা নেওয়ায় গড়িমসি?’

এদিকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকায় মামলাটি করেন ঢাকা আইনজীবী বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক ফারুকী। তিনি ঢাকা আইনজীবী সমিতি ইউনিটের জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক। যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি জানাচ্ছে বিএনপি, সেই আইনে কেন মামলা— এমন প্রশ্নে গণমাধ্যমকে ওমর ফারুক ফারুকী বলেছেন, ‘বিএনপি এখনও এই আইনের বিরুদ্ধে। এখনও তো সেটা বাতিল হয়নি। তাই চলমান যে আইন রয়েছে সেই আইন মোতাবেকই আমাদের এগুতে হবে। আমরা সেটিই করেছি।’

শুরু থেকে তুমুল বিরোধিতার মুখে সরকার বলে আসছিল অনলাইন প্লাটফর্মকে সুরক্ষিত করতেই এই আইন। এর মধ্যেই অনলাইনে নিজের বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য মন্ত্রিসভা থেকে বিতাড়িত হওয়া সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও একজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে বিএনপির এই মামলা সরকারকে তার সেই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণের পরীক্ষায় ফেলবে কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সরকার এমন পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত কিনা এটা বলা বেশ মুশকিল। আমার মনে হয়েছে সরকার এমন পরীক্ষা দিতে চায়ও না। প্রথম থেকেই তারা নানারকম ছলচাতুরি দিয়ে এই আইনকে ব্যবহারই করেছে বেশি। এখন পর্যন্ত সেই ফর্মেশনে কোন পরিবর্তন আমি দেখি না খুব বেশি। পেশাগত জায়গা থেকেও না, আবার একজন নাগরিক বা অধিকারকর্মী হিসেবেও দেখি না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm