নামাজে দরুদ শরীফ পাঠের নিয়ম ও ফজিলত

মুসলমানদের জন্য রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা সকল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। ফেরেশতাগণ ও ঈমানদারকে নবীর প্রতি দরূদ পড়ার নির্দেশ আল্লাহতায়ালা নিজেই দিয়েছেন। নবীর প্রতি দরূদ পড়ার অর্থই হলো-আল্লাহর আদেশের বাস্তবায়ন ও হুকুম পালন করা। হজরত কাব ইবনে ওজারার (রা.) বরাতে হাদিসটি পাওয়া যায়। তিনি বলেন একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম হে আল্লাহর রাসুল! আপনার ওপর আমরা কীভাবে দরুদ পড়ব ? তিনি বললেন বলো : আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিন ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদ কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিম ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর বংশধরদের ওপর এই রূপ রহমত নাজিল করো যেমনটি করেছিলে ইবরাহিম ও তাঁর বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও সম্মানীয়। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর বংশধরদের ওপর বরকত নাজিল করো যেমন বরকত নাজিল করেছিলে ইবরাহিম ও তাঁর বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও সম্মানীয়।

দরুদ শরিফ পড়ার ফজিলত
দরুদ শরিফ পড়ার ফজিলত অপরিসীম। একদিন এক লোক রাসুলুল্লাহ (সা.) এর সামনে নামাজ পড়ে দোয়া করল হে আল্লাহ! তুমি আমার গুনাহ মাফ করো এবং আমার ওপর রহম করো! তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বললেন ওহে মুসল্লি! তুমি খুব তাড়াহুড়া করেছ। শোনো যখন তুমি নামাজ পড়বে তখন প্রথমে আল্লাহর যথাযোগ্য প্রশংসা করবে তারপর আমার ওপর দরুদ পাঠ করবে এবং (সবশেষে নিজের জন্য) দোয়া করবে। ভক্তির সঙ্গে দরুদ শরিফ পড়লে বান্দার গুনাহ মাফ করা হয়। দরুদ পাঠের অশেষ সওয়াব সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি আমার ওপর মাত্র একবার দরুদ পাঠ করে আল্লাহ তার ওপর ১০ বার রহমত নাজিল করেন এবং কমপক্ষে তার ১০টি গুনাহ মাফ করেন। তার আমলনামায় ১০টি সওয়াব লিপিবদ্ধ করেন এবং আল্লাহর দরবারে তাঁর মর্যাদা ১০ গুণ বৃদ্ধি করে দেওয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন সেই ব্যক্তির নাক মাটিতে ঘেঁষে যাক যার কাছে আমার নাম উচ্চারিত হয় অথচ সে আমার ওপর দরুদ পড়ে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী হবে যে ব্যক্তি আমার ওপর সবচেয়ে বেশি দরুদ পড়ে। দৈনন্দিন জীবনে দরুদ শরিফ পাঠ করলে আল্লাহর দরবারে মানুষের দোয়া কবুল হয়। হাদিস শরিফে আছে কোনো দোয়াই আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না যতক্ষণ সে দোয়ার আগে ও পরে নবী করিম (সা.) এর ওপর দরুদ পড়া না হয়। হাদিসে আরও আছে যে ব্যক্তি নবী করিম (সা.) এর পবিত্র নাম শোনার পর তাঁর ওপর দরুদ পড়ে না সে ব্যক্তি সবচেয়ে বড় কৃপণ। তার ধ্বংসের জন্য জিবরাইল (আ.) দোয়া করেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহুতাআলা আনহু হতে বর্ণিত তিনি বলেন আমি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহুতাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ইরশাদ করতে শুনেছি যে ব্যক্তি আমার উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করবে আমি কিয়ামতের দিন তার জন্য সুপারিশকারী হবো।

দরুদ শরিফ না পড়ার পরিণতি
একবার জুমার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন আমিন! অতঃপর দ্বিতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন আমিন! তারপর তৃতীয় ধাপে পা রাখলেন এবং বললেন আমিন! এরপর খুতবা দিলেন ও নামাজ আদায় করলেন। নামাজ শেষে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আজ যা দেখলাম তা ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি (আপনি একেক ধাপে পা রেখে আমিন আমিন আমিন বললেন) এটা কি কোনো নতুন নিয়ম ? নবী করিম (সা.) বললেন না এটা নতুন কোনো নিয়ম নয় বরং আমি মিম্বারে ওঠার সময় হজরত জিবরাইল (আ.) এলেন। আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন আল্লাহতাআলা বলেছেন যারা পিতামাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম আমিন! (তা-ই হোক)। আমি যখন মিম্বারের দ্বিতীয় ধাপে পা রাখি তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন আল্লাহতাআলা বলেছেন যারা রমজান পেল কিন্তু ইবাদতের মাধ্যমে তাদের গুনাহ মাফ করাতে পারল না তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম আমিন! আমি যখন মিম্বারের তৃতীয় ধাপে পা রাখি তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন আল্লাহতাআলা বলেছেন যারা আপনার পবিত্র নাম মোবারক (“মুহাম্মদ”) শুনল কিন্তু দরুদ শরিফ পাঠ করল না তারা ধ্বংস হোক। তখন আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম আমিন!

নামাজে দরুদ শরীফ পড়ার নিয়ম
নামাজের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর দরুদ শরিফ পড়তে হয়। শেষ বৈঠকে দরুদ শরিফ ও দোয়ায়ে মাছুরা পড়া সুন্নত। কেউ যদি কোনো কারণে সুন্নত ছেড়ে দেয়-তাহলেও তার নামাজ হয়ে যাবে। সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হয় না। তবে সওয়াব কিছুটা কমে যায়। তবে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত জেনে-বুঝে সুন্নত ছেড়ে দেয় বা সুন্নত দেওয়াকে নিজের অভ্যাস বানিয়ে ফেলে তাহলে সে গুনাহগার হবে।

যেসব সময়ে দরুদ পড়তে হয়
দুই রাকাত বিশিষ্ট নামাজের দ্বিতীয় রাকাতে এবং চার রাকাত বিশিষ্ট নামাজের শেষ রাকাতে দরুদ শরীফ পড়া আবশ্যক। কেউ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম উচ্চারণ করলে তার নিজের এবং কেউ তা পাশ থেকে শুনলে তার জন্য দরুদ শরীফ পড়া আবশ্যক।

দরুদে ইবরাহিমের উচ্চারণ
আল্লাহুম্মা ছাল্লি আলা মুহাম্মাদিউঁ ওয়া আলা-আ-লি মুহাম্মাদিন কামা ছাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিউঁ ওয়া আলা-আ-লি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। /wp-admin/media-upload.php?post_id=235877&type=image&TB_iframe=1

দরুদে ইবরাহিমের অর্থ
হে আল্লাহ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর শান্তি বর্ষণ করো যেভাবে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর শান্তি বর্ষণ করেছিলে। নিশ্চয়ই তুমি অতি প্রশংসিত মহিমান্বিত। হে আল্লাহ! মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দান করো যেভাবে ইবরাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দান করেছিলে। নিশ্চয়ই তুমি অতি প্রশংসিত মহিমান্বিত।

হজরত ওমর ফারুক (রা.) বলেন দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত আসমান ও জমিনের মধ্যখানে আটকে থাকে ওপরে ওঠে না যতক্ষণ পর্যন্ত নবী করিম (সা.) এর ওপর দরুদ না পড়ে। হজরত আলী (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন প্রকৃত কৃপণ সেই ব্যক্তি যার কাছে আমি উল্লিখিত হলাম (আমার নাম উচ্চারিত হল) অথচ সে আমার প্রতি দরূদ পাঠ করল না। হজরত ইবনে মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন কিয়ামতের দিন সেই ব্যক্তি সব লোকের তুলনায় আমার বেশি নিকটবর্তী হবে যে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমার ওপর দরূদ পড়বে। রাসুলের রওজা মোবারকের কাছে গিয়ে তার প্রতি দরুদ পাঠ করলে রাসুল (সা.) তা সরাসরি শুনতে পান। এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন যে ব্যক্তি আমার কবরের কাছে এসে আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে আমি তা সরাসরি শুনতে পাই। আর যে ব্যক্তি দূর থেকে আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে তা আমার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

দরুদ পাঠকারীর জন্য ফেরেশতাদের দোয়া
দরুদ পাঠকারীর জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন। আমির বিন রাবিআহ (রা.) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেন যখন কোনো মুসলিম আমার প্রতি দরুদ পাঠ করে এবং যতক্ষণ সে আমার প্রতি দরুদ পাঠরত থাকে ততক্ষণ ফেরেশতারা তার জন্য দোয়া করতে থাকেন। অতএব বান্দা চাইলে তার পরিমাণ (দরুদ পাঠ) কমাতেও পারে বা বাড়াতেও পারে। (সুনানে ইবনে মাজাহ : হাদিস : ৯০৭)। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সঙ্গে মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ : ‍‘ওয়া আশহাদু আল্লা ইলাহা’র সঙ্গে ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদূহু ওয়া রাসুলুহু, ‘বিসমিল্লাহ’র সঙ্গে ওয়া আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ, ‘মার রাববুকা’র সঙ্গে মান হাজার রাজুল’কে-এমনভাবে যুক্ত করা হয়েছে যে একটি অপরটি থেকে আলাদা হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। যেখানেই আল্লাহতায়ালার কথা সেখানেই তার সবচে প্রিয় ও সবচেয়ে সম্মানিত বান্দার আলোচনা।

দরূদ শরিফের সৌন্দর্য ও তাৎপর্যের মধ্যে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এতে একই সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওাসাল্লামের হক আদায়, উভয়ের প্রতি ভালোবাসায় দৃঢতা, সুন্নতের অনুসরণের সুযোগ, আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায়, উভয়ের সন্তুষ্টি অর্জন, হাশরের ময়দানে নবী করিমের সুপারিশ লাভ ও নিজের উন্নতি ও মরতবা বৃদ্ধি-সবকিছুই নিহিত রয়েছে।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহতায়ালার আখেরী রাসূল। তিনি গোটা মানবজাতির জন্য আল্লাহতায়ালার সর্বশেষ দূত। তাই তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য ছাড়া আল্লাহতে বিশ্বাস ও আল্লাহর আনুগত্যের দাবি অর্থহীন। নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতে মুসলিমাহকে দরুদ পড়ার নিয়ম ও পদ্ধতি শিখিয়েছেন। যাতে তারা সব সময় নবিজীর প্রতি দরুদ পড়তে পারেন এবং নামাজের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর তাঁর শেখানো পদ্ধতিতে দরুদ পড়তে পারেন। সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো পদ্ধতিতে নামাজের শেষ বৈঠকে তাশাহহুদের পর দরুদ শরিফ পড়া ও হাদিসের ওপর আমল করা। আল্লাহতাআলা মুসলিম উম্মাহকে নামাজের শেষ বৈঠকে উল্লেখিত দরুদ পড়ার তাওফিক : নবিজী ও তাঁর পরিবারের প্রতি রহমত ও বরকত কামনা করার মাধ্যমে পরকালে তাঁর সুপারিশ পাওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!