গোপনে এস আলমের গাড়ি সরানোর সেই বিতর্কিত ঘটনায় দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন তিনি, পরে ফিরিয়ে দেওয়া হয় পদ। এবার চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়নও পেয়েছেন এনামুল হক এনাম। কিন্তু বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে এনামের সেই ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তুলে এবার বেঁকে বসেছেন দলেরই চার প্রভাবশালী নেতা। তাদের দাবি, এস আলম সংশ্লিষ্টতার কারণে এনামের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, যা এই আসনে বিএনপির জয়ের পথে বড় বাধা হতে পারে। এমন আশঙ্কায় মনোনয়ন পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা।

মনোনয়ন বাতিল চেয়ে আবেদন
গত ৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনামকে চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই স্থানীয় রাজনীতিতে শুরু হয় তোলপাড়।

এনামের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বরাবর লিখিত আবেদন জানিয়েছেন ওই আসনের চার মনোনয়নপ্রত্যাশী। আবেদনে স্বাক্ষর করেছেন চট্টগ্রাম-১২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহজাহান জুয়েল, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. ইদ্রিস মিয়া এবং দক্ষিণ জেলা বিএনপির দুই যুগ্ম আহ্বায়ক রেজাউল করিম নেছার ও সাইফউদ্দিন সালাম মিঠু।

চিঠিতে এই চার নেতা উল্লেখ করেন, তারা পারস্পরিক বোঝাপড়া ও আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়েছেন যে তাদের চারজনের মধ্য থেকে যাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হবে, তিনি এই আসনটি দলকে উপহার দিতে পারবেন। গাজী শাহজাহান জুয়েলের দুইবারের সংসদ সদস্য হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং ইদ্রিস মিয়ার উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তারা বলেন, এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে নির্বাচন করলে বিএনপির জয়লাভ সহজ হবে। কিন্তু প্রাথমিকভাবে মনোনীত প্রার্থীর এস আলম কাণ্ড এবং সংশ্লিষ্টতায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এই চিঠি দেওয়ার ১০ দিন আগে শাহজাহান জুয়েলের বাড়িতে দোয়া চাইতে গিয়েছিলেন এনাম।
এস আলম ও গাড়িকাণ্ড বিতর্ক
দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলমের তদবিরেই এনামুল হক এনামকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের কালুরঘাট এলাকার মীর গ্রুপের একটি ওয়্যারহাউস থেকে একে একে ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি বের করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। অভিযোগ ওঠে, এস আলম গ্রুপের এই গাড়িগুলো গোপনে সরিয়ে নেওয়ার কাজ তদারকি করছিলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির তৎকালীন আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া। এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের মেয়ের শ্বশুর এবং মীর গ্রুপের মালিক আবদুস সালাম সম্পর্কে বিএনপি নেতা এনামুল হক এনামের আপন মামাতো ভাই। সেই সূত্রে এনাম এস আলমের বিয়াই হন।
গাড়ি সরানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ঘটনার দুই দিন পর আবু সুফিয়ান ও এনামসহ তিন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। এর পরদিন ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় এবং তিনজনের প্রাথমিক সদস্যপদ স্থগিত করা হয়। তবে গত বছরের ২৫ ডিসেম্বর ভবিষ্যতে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হবে না—এমন সতর্কবাণী দিয়ে তাদের দলীয় সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় নেতাকর্মীদের ধারণা, এস আলমের তদবিরেই তাদের দলে পুনর্বহাল করা হয়েছিল এবং এখন মনোনয়নও দেওয়া হয়েছে।
নেতাকর্মীদের ক্ষোভ ও অলি আহমদের ইঙ্গিত
এনামকে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ সন্তোষ প্রকাশ করলেও, দল থেকে বহিষ্কৃত এবং এস আলমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ থাকা একজনকে প্রার্থী করায় অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এনামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও দলের শীর্ষ নেতারা তাতে গুরুত্ব দেননি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
এদিকে গত ৬ নভেম্বর বিএনপির মিত্র হিসেবে পরিচিত লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) প্রেসিডেন্ট অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল অলি আহমদ বীর বিক্রম এক বক্তব্যে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনও হাসিনার লোকজন সক্রিয় রয়েছে। কেউ এস আলমের মাধ্যমে, কেউ কেউ অন্যভাবে। এখন শুনতেছি এস আলমের লোকজন নমিনেশন পাচ্ছে। এটা আমার কথা না, জনগণের কথা। আমিও তাদের সাথে একমত।’ অলি আহমদের এই বক্তব্যে এনামের মনোনয়ন প্রসঙ্গটি পরোক্ষভাবে উঠে এসেছে বলে মনে করেন অনেকে।
প্রসঙ্গত, এনামুল হক এনাম ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পটিয়া আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সামশুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।
সিপি




