হালিশহর-নিউমার্কেট রুটে রমরমা অবৈধ ‘টিকটিকি’, মাসে চাঁদাবাজি ১৪ লাখ

চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ৩০০ অবৈধ সবুজ অটোটেম্পো (টিকটিকি)। এই রুটে একসময় হলুদ টেম্পো চলাচলের অনুমতি থাকলেও পরে তা দখলে নেয় এসব টিকটিকি। এসব গাড়ির কোনো ধরনের রুট পারমিট নেই। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এসব গাড়ি বাজেয়াপ্ত করলে মালিকপক্ষ হাইকোর্টে রিট করে দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে। আর এ সুযোগে দাপিয়ে চাঁদাবাজি করছে একটি চক্র। প্রতিটি গাড়ি থেকে ‘চট্টগ্রাম জেলা অটো টেম্পো অটো রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়ন’র রশিদে চালকদের কল্যাণের নামে মাসে প্রায় ১০ লাখ টাকা চাঁদা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। আবার এসব গাড়ি থেকে মাসে ১৩০০ টাকা করে ‘শ্রমিকদের বিপদ-আপদের ভরসা’র নামে হাতিয়ে নিচ্ছে ওই চক্র, যা মাসে দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ টাকা।

জানা গেছে, হালিশহরের ফইল্ল্যাতলী বাজার থেকে দেওয়ানহাট হয়ে নিউমার্কেট পর্যন্ত চলাচল করে প্রায় ৩০০ সবুজ টিকটিকি। গাড়িগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় ফইল্ল্যাতলী বাজার থেকে। এই রুটে টেম্পো চলাচলের পারমিট থাকলেও এসব গাড়ি বাজেয়াপ্ত করে বিআরটিএ। কিন্তু গাড়ির মালিকপক্ষ হাইকোর্টে রিট করে আগামী ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত চলাচলের অনুমতি নিয়ে আসে। তবে তাদের রিটে গাড়ির সংখ্যা উল্লেখ ছিল না। আর এসব গাড়ি থেকে চাঁদাবাজি করেন মো. সফি ওরফে তিন নম্বর সফি নামের এক ব্যক্তি। তার সঙ্গী হিসেবে আছে ছেলে মহিউদ্দিন এবং সাইফুল ইসলাম রনি, মো. মামুন ওরফে ডিম মামুন ও মো. আজাদ। এদের মধ্যে সফির ব্যক্তিগত সহকারী আজাদ এবং ক্যাশিয়ার হলেন মো. মামুন ওরফে ডিম মামুন। এছাড়া হালিশহর ফইল্ল্যাতলী বাজার থেকে নিউমার্কেট মোড় পর্যন্ত পাঁচটি স্পটে রয়েছে তাদের পাঁচজন লাইনম্যান। তারা হলেন—আজাদ, আলাউদ্দিন, দেলোয়ার, মোরশেদ ও মিজান।

আরও জানা গেছে, সফি বাহিনী প্রতিদিন গাড়িপ্রতি ১২০ টাকা দৈনিক চাঁদা নেন। মাসে এই অঙ্ক দাঁড়ায় প্রায় ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। তারা এই চাঁদা নেন চট্টগ্রাম জেলা অটো টেম্পো অটো রিক্সা শ্রমিক ইউনিয়নের রশিদে ‘শ্রমিকদের কল্যাণ’র নাম দিয়ে। এছাড়া প্রতিটি গাড়ি মাসে ১৩০০ টাকার একটি আলাদা চাঁদা দেয় সফি বাহিনীকে। এই টাকার পরিমাণ মাসে দাঁড়ায় ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা। এসব টাকার ভাগ স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পকেটে যায়।

মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) সরেজমিন হালিশহরের ফইল্ল্যাতলী বাজারের সামনে গিয়ে দেখা গেছে, বেশ কয়েকটি সবুজ টিকটিকি দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। গাড়ির লাইন নিয়ন্ত্রণ করছেন কয়েকজন ব্যক্তি।

বেশ কয়েকজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব গাড়ি কথিত শ্রমিক লীগ নেতা মো. সফি নিয়ন্ত্রণ করেন। এই রুটে তার মালিকানাধীন চট্টগ্রাম-ফ-১১-০১৭৯ নম্বরের একটি গাড়ি আছে। এছাড়ার তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে পরিচিত আজাদের নামে আছে ১১-০৫১৯, ১১-০৬০০ এবং ১১-০৪৭৬ নম্বরের তিনটি গাড়ি। সফির লোকজন প্রতিটি গাড়ি থেকে দৈনিক ‘শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন বা ওয়াবিল’র নামে তোলা হয় ১২০ টাকা। ৩০০ টি গাড়ি থেকে দৈনিক চাঁদার পরিমান দাঁড়ায়,৩৬ হাজার টাকা। আর মাসে সেই চাঁদার পরিমান দাঁড়ায় ১০ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। আর মাসিক মান্তলি হিসেবে তোলা হয় গাড়ি প্রতি ১৩ শ টাকা। যার মাসিক চাঁদার পরিমান দাঁড়ায়, ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। শুধু এই অবৈধ রুটেই চাঁদা আদায় হয় ১৪ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা। এই টাকা উত্তোলনের দায়িত্বে আছেন সাইফুল ও মো. মামুন ওরফে ডিম মামুন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের ২০ এপ্রিল র‌্যাবের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে নগরীর পাহাড়তলী থানার বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে মো. সফি ও তার তিন সহযোগী চাঁদার টাকাসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। ফইল্ল্যাতলী বাজার খাল পাড়ে সফির রয়েছে ১৮টি ভাড়া ঘর। এছাড়া সীতাকুণ্ডে দেড় কোটি টাকা মূল্যের বিশাল জায়গার মালিকও তিনি।

চাঁদাবাজি বন্ধে গাড়ির মালিকরা পুলিশ কমিশনার বরাবরে একাধিকবার অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালিকপক্ষের এক অভিযোগকারী বলেন, ‘কথিত শ্রমিক সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে দীর্ঘ ১০ বছর চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে মো. সফি। অভিযোগ দেওয়ার পর পুলিশ একাধিকবার অভিযান চালায়, র্যা বও চাঁদার টাকাসহ সফিকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে—কিন্তু জামিনে বেরিয়ে ফের চাঁদাবাজি করে তারা।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কথিত শ্রমিক লীগ নেতা মো. সফি বলেন, ‘আমি কোনো চাঁদাবাজি করছি না, এগুলো ভুল কথা। আপনি মিথ্যা তথ্য পেয়েছেন।’

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক পশ্চিম বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার নিস্কৃতি চাকমা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই গাড়িগুলো চালানোর জন্য মালিক পক্ষ থেকে কিছু গাড়ির রিট করা হয়েছে। আর ডকুমেন্টস ছাড়া গাড়ি চলাচল ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো।’

আরএন/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm