আজব টেন্ডারে কাগুজে প্রতিষ্ঠান গোপনে পেল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারির বড় কাজ
টেন্ডার নিয়ে সীমাহীন অনিয়ম, ৩ মাসেও খোলা হয় না বাক্স
বাস্তবে অস্তিত্ব না থাকলেও কাগজেকলমে প্রতিষ্ঠান সাজিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের দরপত্রে অংশ নেয় সদর উদ্দিন সন্স নামে নারায়ণগঞ্জের একটি প্রতিষ্ঠান। গত বছরের ৩ অক্টোবর পেট্রোলিয়াম স্লাজ বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। এরপর মেসার্স নাজমা অয়েল এন্ড কোম্পানি, মেসার্স শাহ্ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্স ও সদর উদ্দিন সন্স নামের মোট তিনটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে।
১৮ অক্টোবর দরপত্র খোলার তারিখ থাকলেও তিন মাসেও সেই দরপত্র খোলা হয়নি আর। দরপত্র জমা দেওয়ার পর তিন মাস পার হয়ে গেলেও দরদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কোনো সদুত্তর পাচ্ছে না। তবে দুটি দরদাতা প্রতিষ্ঠান নাজমা অয়েল এবং শাহ আমানত অয়েল জানতে পারে, অনিয়মের মাধ্যমে প্যাডসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান সদর উদ্দিন সন্সকে কাজটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি জানতে পেরে গত রোববার (২ জানুয়ারি) ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডকে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছে মেসার্স নাজমা অয়েল এন্ড কোম্পানি এবং শাহ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্স। আইনি নোটিশ ছাড়াও ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সদর উদ্দিন সন্সের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ এনে চিঠি দিয়েছে শাহ আমানত অয়েল।
আইনি নোটিশে বলা হয়, সদর উদ্দিন সন্স মূলত একটি মোবাইলসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান। একেক সময়ে একেক প্যাড ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন দরপত্রে অংশ নিয়ে অবৈধভাবে কাজ বাগিয়ে নেয়। প্যাডে উল্লেখিত ঠিকানায় কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই।
আইনি নোটিশে বলা হয়েছে, নাজমা অয়েল এন্ড কোম্পানি ৪০ বছর ধরে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের শর্ত পূরণ সাপেক্ষে কোয়ালিফাই হয়ে টেন্ডারের মাধ্যমে স্লাজ কেনার ব্যবসা করে আসছে। অতীতের মত সকল নিয়ম মেনে এবারও আবেদন করলেও দীর্ঘদিন ধরে টেন্ডার খোলার বিষয়ে কিছু জানতেই পারেনি প্রতিষ্ঠানটি।
টেন্ডার জমা দেওয়ার পর দরপত্রের শর্ত মতে দরখাস্ত করা হয়েছে কিনা প্রথমে কারিগরি কমিটিতে যাচাই-বাছাই করা হয়। কারিগরি কমিটির যাচাইয়ে উত্তীর্ণ হলে বাণিজ্যিক দরপত্র খোলার পৃথক তারিখ ঘোষণা ও দরপত্র নিশ্চিত নিরপেক্ষ করার জন্য দরপত্র খোলার তারিখ ও সময় দরপত্রদাতাকে আগাম জানানোর বিধান আছে।
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড যদি দীর্ঘদিন টেন্ডার না খোলে, সে ক্ষেত্রে যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে যে কোনো ওয়ার্ক অর্ডার আইন পরিপন্থী হিসেবে গণ্য হবে। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের বিরুদ্ধে নোটিশদাতা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন বলেও আইনি নোটিশে উল্লেখ করা হয়।
একই দিন (২ জানুয়ারি) মেসার্স শাহ্ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্সের পক্ষে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন ইস্টার্ন রিফাইনারি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে ‘কাগুজে প্রতিষ্ঠান’ সদর উদ্দিন সন্স নামের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পেট্রোলিয়াম স্লাজ বিক্রয় টেন্ডারের অনিয়ম এনে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সদর উদ্দিন সন্স নামের প্রতিষ্ঠানের লেটারহেডে উল্লেখিত ঠিকানা এবং লাইসেন্সের ঠিকানার মধ্যেই মিল নেই।
ঠিকাদার সদর উদ্দিন সন্সের দেওয়া তিনটি লাইসেন্সের মধ্যে দুটি ঠিকানায় ওই প্রতিষ্ঠানের কোনো ডিপো কিংবা অফিসের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। নারায়ণগঞ্জ জেলার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকার বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্রে যে দুটি ঠিকানা দেখানো হয়েছে তাও এক নয়।
জানা গেছে, তথ্য গোপন রেখে টেন্ডারের জন্য আবেদন করেছিল সদর উদ্দিন সন্স। যা একটি বেসরকারি সার্ভে কোম্পানির রিপোর্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে— এমন দাবি করেছে শাহ্ আমানত অয়েল সাপ্লাইয়ার্স। অথচ ইস্টার্ন রিফাইনারি স্লাজ বিক্রয়ের দরপত্রের শর্তেই উল্লেখ রয়েছে, অবশ্যই ঠিকাদারের ডিপোর নকশা ও ডিপোর অফিস থাকতে হবে।
সদর উদ্দিন সন্সের মালিক জসিম উদ্দিন খানকে ফোন করা হলে নারীকন্ঠে অজ্ঞাতনামা একজন বলেন, ‘তিনি বাসায় নেই।’ এরপর দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনের পরিচয় দেওয়ার পর ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। এরপর একাধিকবার ফোন করেও সদর উদ্দিন সন্সের কথিত মালিক জসিম উদ্দিন খানের সাথে যোগাযোগ করা যায়নি।
এ বিষয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারি কোম্পানির এজিএম আহম্মেদ ফজলে রাব্বি ৪ জানুয়ারি মুঠোফোনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, নাজমা অয়েল এন্ড কোম্পানির দেয়া আইনি নোটিশ এখনও পর্যন্ত ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের কাছে পৌঁছায়নি। পাশাপাশি মেসার্স শাহ্ আমানত অয়েলের দেওয়া লিখিত অভিযোগও এখনও পাওয়া যায়নি।
তবে বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় আবারও ফোন করা হলে তিনি নোটিশ প্রাপ্তির কথা স্বীকার করে বলেন, ‘নোটিশ পেয়েছি, কিন্তু এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করা যাবে না।’
নাজমা অয়েল এন্ড কোম্পানির স্বত্ত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ইস্টার্ন রিফাইনারি কর্তৃপক্ষ স্লাজ বিক্রির দরপত্র নিয়ে কোনো অনিয়ম করলে আমরা উচ্চ আদালতে রিট করবো।’
এসকেএস/কেএস/সিপি