গুজব নিরসনে তথ্য অধিকার আইনের ভূমিকা

ভুল, মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য যখন যাচাই-বাছাই ছাড়াই মানুষের মুখে মুখে কিংবা বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কিংবা প্রচারিত হয়, তখন তাকে গুজব হিসেবে অভিহিত করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই সমাজে এ ধারাটি প্রচলিত ছিলো। গুজব বিশ্বের সকল দেশেই কম-বেশি প্রচারিত হয়। তবে সভ্যতার সাথে সাথে কিংবা সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গুজব প্রতিরোধ করা সহজ হয়। উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত রাষ্ট্রে গুজব সামাজিক ও রাষ্ট্রের জন্য একটি অন্যতম বিষফোঁড়া এবং উন্নয়নের অন্তরায়। একশ্রেণির মানুষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ভিত্তিহীন তথ্যকে সংবাদ বানিয়ে গুজব প্রচার করে। সময়ে সময়ে এসব ষড়যন্ত্রকারীরা সরব হয়ে ওঠে।কোন একটি রোগকে গুজবে পরিণত করে প্রচার করার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ কিংবা সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। গুজব নিরসনে তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার তথ্যওসম্প্রচারমন্ত্রণালয়ের অধীন গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের ৬৮টি তথ্য অফিসের মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষকে জনসাধারণকে স্মার্ট লিটারেসি (Smart Literacy)বিষয়ে অবহিত ও গুজব প্রতিরোধে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া তথ্য অধিদপ্তর কর্তৃক তৈরিকৃত “ফ্যাক্ট চেক মিডিয়াসেল” এর সঠিক তথ্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে গুজব প্রতিরোধে অগ্রনী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

বর্তমান সময়ে যে সকল সামাজিক সমস্যা ব্যাধিতে রূপ ধারণ করতেছে তাদের মধ্যে গুজব অন্যতম। পূর্বে গুজব মুখে মুখে প্রচারিত হতো। পরবর্তীতে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে এবং অব্যাহত অগ্রগতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব প্রচার হচ্ছে। ফেসবুক, টুইটার, মেসেঞ্জার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সট্রাগ্রাম বর্তমানে সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগাযোগ মাধ্যম। বিশ্বায়নের এ যুগে এসব যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের প্রতিদিনের নিত্যসঙ্গী এবং তথ্য আদান-প্রদানের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। এসব মাধ্যমে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে ঘটে যাওয়া খবর খুব সহজে জানতে পারে। তাই কিছুক্ষণ পরপরই এসব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সর্বশেষ তথ্য জেনে নেয়।

এক গবেষণায় দেখা গেছে বিশ্বের ৫০টি দেশে ৫৪% মানুষের সংবাদ পাওয়ার প্রধান মাধ্যম হচ্ছে ফেসবুক। সাধারণ মানুষের অসচেতনতা গুজব ছড়ানোর প্রধান কারন। গুজব ছড়ানো যেমন বিভিন্ন পর্যায়ের ষড়যন্ত্র, তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসাধুদের টাকা আয়েরও অন্যতম উৎস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাজিয়ে গুছিয়ে অলংকৃত গুজব সর্বসাধারণ যত বেশি দেখবে, ততবেশি টাকা উপার্জন করতে পারে। বাংলাদেশ ফ্যাক্ট -চেকিং সংস্থা রিউমর স্ক্যানার এর মতে, ২০২৩ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ১৯১৫ টি গুজব ও ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজনৈতিক বিষয়ে ৫৯৭টি।

‘জ্ঞানই শক্তি’ যখন ‘তথ্যই শক্তি’তে রূপান্তর, তখন তথ্যের অবাধ প্রবাহ জনগনের সাংবিধানিক অধিকার। সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত চিন্তা, বিবেক ও বাক-স্বাধীনতা এবং সুশীল সমাজ ও অংশীজনদের দাবির প্রেক্ষিতে জনগণের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকল্পে বিশ্বের উন্নত দেশের আদলে তথ্য অধিকার আইন – ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়েছে। উক্ত আইনে ৮টি অধ্যায় এবং ৩৭টি ধারা রয়েছে। বিদ্যমান সকল আইন থেকে উক্ত আইনটি ব্যতিক্রম। প্রায় সকল আইন প্রয়োগ করা হয় জনগণের উপর, অন্যদিকে তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগ হচ্ছে ২ নং ধারার সংজ্ঞায় উল্লেখিত কর্তৃপক্ষের উপর। আইনটির ২ ও ৬ নং ধারা মোতাবেক সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংবিধিবদ্ধ সংস্থা, সরকারি ও বিদেশী অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্ব প্রণোদিত হয়ে অনুমোদিত সকল তথ্য প্রকাশ করবেন। উক্ত আইনের ১০ নং ধারা মোতাবেক প্রত্যেকটি দপ্তরে একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা থাকবেন, যিনি আইনের ৭ এবং ৩২ নং ধারায় উল্লেখিত বিষয় ব্যতিত সকল বিষয়ে তথ্য প্রদানে বাধ্য।

গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের প্রতিযোগিতা অনেক পুরনো। বিশেষ করে নির্বাচনের পূর্বে কিংবা বিভিন্ন ক্রান্তিলগ্নে গুজব সৃষ্টি এবং ছড়ানোর মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির কৌশল গতানুগতিক অনেক পুরনো ধারা। যুদ্ধকালীন গুজব ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করা যুদ্ধের অন্যতম অপকৌশল।রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্যই বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্রকারী ও স্বার্থান্বেষী মহল গুজব প্রচার করে। ফ্রিডম অব দ্য নেট রিপোর্ট ২০১৭ সালে এক জরিপে দেখেছে যে তুরস্ক, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইনসহ ১৭ টি দেশে তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়ে গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। গুজবে সবসময় ভুক্তভোগী হচ্ছে নিরীহ মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে প্রচার করা গুজবের মধ্যে মেট্রোরেল স্টেশনের ডিজিটাল স্ক্রিনে বাংলা নেই, অভিনেতা জায়েদ খানের জাতিসংঘ পুরস্কার অর্জন, ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের উৎসে কর কর্তন, মোবাইল ফোনে বিজয় কি-বোর্ড বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, ২০২৪ সালের এসএসসি পরীক্ষার ভুয়া রুটিন, বাতিল হচ্ছে ডিজিটাল ভূমি জরিপ প্রকল্প, বাংলাদেশের পরিণাম শ্রীলঙ্কার মতো, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৬০ শতাংশ বেতন বৃদ্ধির ঘোষণা প্রধানমন্ত্রীর ইত্যাদি। বাংলাদেশের অহংকার পদ্মা সেতু নির্মাণে শিশুর মাথা খোঁজা হচ্ছে বলে একটি গুজব ২০১৯ সালে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ছেলে ধরা সন্দেহে সাভারে বাসা ভাড়া নিতে যাওয়া এক মাকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা হয়। সারাদেশে তখন গণপিটুনিতে প্রায় অর্ধশত লোক গুজবের বলি হতে হয়। এ ক্ষেত্রে জনসাধারণ যদি সচেতন হতেন তাহলে মানুষকে গণপিটুনি না দিয়ে তথ্য অধিকার আইন- ২০০৯ এর ৮ ধারা অনুসারে ‘পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ’ বরাবর নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে সঠিক তথ্য জানতে পারতেন। প্রাপ্ত তথ্য যদি মনঃপুত না হতো তাহলে আইনের ২৪ ধারা অনুসারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট আপীল এবং অনুরূপ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে আইনের ২৫ ধারা অনুসারে তথ্য কমিশনে অভিযোগ করে সঠিক তথ্য জানতে পারলে এতগুলো তাজা প্রাণ প্রাণহীন হতো না।

বিশ্বায়নের এ যুগে স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যত সহজে একটি তথ্য পাওয়া যায়, ঠিক তার চেয়েও অল্প সময়ে- বিদ্যুৎ বেগেগুজবছড়িয়ে পড়ে এবং ভাইরাল হয়ে যায়। আক্রান্ত হয় পরিবার, সমাজ, গোত্র, ধর্ম, বর্ণ, রাষ্ট্র। গুজব ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মাধ্যমে সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অন্যতম অস্ত্র। সঠিক তথ্য প্রবাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে গুজব, অনুমান নির্ভর, বিকৃত ও ভুয়া তথ্য নিরসন সম্ভব।ভুঁইফোঁড় কিছু অনলাইন ওয়েবপোর্টাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ারের মাধ্যমে গুজব প্রচার করে। সেজন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার লিটারেসি বা ব্যবহার জ্ঞান বর্তমানে অত্যাবশ্যক।

পিআইডি ফিচার
লেখক: তথ্য অফিসার, জেলা তথ্য অফিস, পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!