ঘরে ঢুকে এমপির লোকেরা বেদম পেটালো বাঁশখালীর মুক্তিযোদ্ধা মেয়রকে (ভিডিও)
‘তুই এমপির সঙ্গে বেয়াদবি করছিস কেন’— বলেই বেদম মার
পৌরসভা ভোটের দুইদিনের মাথায় ‘এমপির লোক’ পরিচয়ে একদল দৃর্বৃত্ত ঘরে ঢুকে টেনেহিঁচড়ে মারধর করলো বাঁশখালী পৌরসভার বিদায়ী মেয়র মুক্তিযোদ্ধা শেখ সেলিমুল হক চৌধুরীকে। ‘তুই এমপির সঙ্গে বেয়াদবি করছিস কেন’— এমন প্রশ্ন তুলে ওই দুর্বৃত্তরা একপর্যায়ে মেয়র সেলিমের শার্টও ছিঁড়ে ফেলেন। সাংসদের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ধারণা করছেন।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় পৌরসভার মিয়ার বাজার এলাকার একটি বাসায় এ ঘটনা ঘটে। পরে খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে সেলিমুল হক চৌধুরীকে উদ্ধার করে তার বাসায় পৌঁছে দেয়।
একসময় ঘনিষ্ঠতা থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে বাঁশখালীর সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন বাঁশখালী পৌরসভার বিদায়ী মেয়র মুক্তিযোদ্ধা শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী।
জানা গেছে, মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় বিদায়ী মেয়র সেলিমুল হক বাঁশখালী উপজেলা যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হীরা মনির বাসায় যান। সেখানে ওই সময় পৌরসভা যুবলীগের আহ্বায়ক হামিদ উল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। এ সময় হঠাৎ কয়েকজন যুবক ওই বাসায় ঢুকে প্রথমে বিদায়ী মেয়র সেলিমুল হকের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ে জড়িয়ে পড়েন। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মারধর করতে শুরু করেন সেলিমকে। ওই যুবকেরা বিদায়ী মেয়রকে টেনেহিঁচড়ে সোফা থেকে মাটিতে নামিয়েও মারতে থাকেন।
মারধরের সময় যুবকেরা বলছিলেন, ‘তুই এমপির সঙ্গে বেয়াদবি করছিস কেন?’ এর একপর্যায়ে তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিমের শার্টও ছিঁড়ে ফেলেন।
উপজেলা যুব মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হীরা মনি বলেন, ‘পৌর নির্বাচনে আমার ভাই মানিক বিজয়ী হতে না পারায় আমি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে থাকলে আমার মা, বোন ও ভাবী আমাকে দেখতে আসেন। কিছুক্ষণ পর পৌরসভা যুবলীগের আহ্বায়ক হামিদ উল্লাহ আমার বাসায় আসেন। এর একটু পর বর্তমান মেয়র মুক্তিযোদ্ধা শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী আমার বাসায় এসে হাঁপাতে হাঁপাতে তাকে বাঁচাতে বলেন। তাকে নাকি কিছু লোক মারতে চাইছে।’
হীরা মনি বলেন, ‘আমার বাসায় এসে কিছু যুবক মেয়রকে টানাহেঁচড়া করে। আমি তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করেছি। ঘটনার কিছুক্ষণ পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত একটি ভিডিওতে মেয়রকে টানাহেঁচড়া করে ২-৩ জন যুবককে তার পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলতে দেখা যায়।’
ঘটনাস্থলে থাকা পৌরসভা যুবলীগের আহ্বায়ক হামিদ উল্লাহ বলেন, ‘মেয়র বাসায় থাকাকালীন কিছু যুবক এসে চড়াও হয়। পরে পুলিশ এসে মেয়রকে চলে যেতে বলে।’
এদিকে রাত পৌনে আটটার দিকে মিয়ার বাজার এলাকার ওই বাসা থেকে মেয়র সেলিমুল হককে উদ্ধার করে তার বাসায় পৌঁছে দেয় পুলিশ। এরপর থেকে এলাকায় চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে।
পৌরসভা এলাকার এমপির অনুসারী সিরাজের নেতৃত্বেই এই হামলা হয়েছে স্থানীয় সূত্রগুলো দাবি করেছে। আবার অনেকের ধারণা, ঘটনাটি ঘটেছে যুবলীগের আহবায়ক হামিদের ইন্ধনেই। কৌশলে বাসায় ডেকে এনে মেয়রের ওপর হামলা হয়েছে— এমনও মনে করছেন কেউ কেউ।
২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বরে বাঁশখালী পৌরসভার তৃতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী। তবে এবার অনুষ্ঠিত সর্বশেষ নির্বাচনে সাংসদ মোস্তাফিজুরের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে তিনি আর মনোনয়ন পাননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মেয়র নির্বাচিত হওয়ার দুই বছরের মাথায় ২০১৭ সাল থেকে সাংসদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন সেলিমুল হক। এর জের ধরে ২০১৮ সালে মেয়রের গাড়িতে হামলা চালানো হয়। পরে ওই বছরের ২৮ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১ এর আদালতে পৌর মেয়র সেলিমুল হক চৌধুরীসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন এক কলেজছাত্রী। এই দুটি ঘটনার জন্য সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমানকে দায়ী করে আসছেন সেলিমুল হক।
একই বছরের আগস্টে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে চট্টগ্রামের বাঁশখালী আসনের সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনেন পৌরসভার মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরী। ওই সময় তিনি অভিযোগ করেন, ‘দুর্নীতির দায়ে জেলে যেতে হবে বলে সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান সার্বক্ষণিক আতঙ্কে থাকেন। বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পে অনিয়ম, টিআর/কাবিখা লুটপাট, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি নিয়োগে বাণিজ্য, স্কুল ও কলেজে শিক্ষক নিয়োগে বাণিজ্য, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ ও মারধর, সাংবাদিকদের হুমকিধমকি দেওয়া তার স্বভাবে পরিণত হয়েছে।’
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেব্রুয়ারিতে এমপি মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরীর অশ্রাব্য গালাগালের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ওই ভিডিওতে তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। ওই ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘লিটন (আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল্লাহ কবির লিটন) কি চনু! ইতার মারে চুদি! নমিনেশন না পাইলে পাবো না! এই কাদেরগ্যা (ওবাইদুল কাদের) চুদানির পোয়ারে আগে নেত্রীর সামনে পিডাবো আমি! আলা খানকির পোয়া!…’
এতো সব ঘটনার পর ২০২০ সালের ২৪ আগস্ট চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান কর্মসূচিতে সাংসদ মোস্তাফিজুর রহমান পক্ষ হয়ে হামলার ঘটনায় শিরোনাম হন পৌর মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরীও। মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফকে নিয়ে এমপি মোস্তাফিজুর রহমান বিতর্কিত মন্তব্য করা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য দেওয়ার প্রতিবাদে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও সন্তান কমান্ড চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলা শাখা যৌথভাবে ওই মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি আয়োজন করেছিল। কিন্তু পৌর মেয়র শেখ সেলিমুল হকের নেতৃত্বে মোস্তাফিজুর রহমানের অনুসারীরা হামলা চালিয়ে অনুষ্ঠানটি পণ্ড করে দেয়। এতে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকসহ ২৫ জন। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানায় দায়ের করা মামলায় পৌর মেয়র শেখ সেলিমুল হক চৌধুরীসহ ২৬ জনকে আসামি করা হয়।
তবে এরপরও সেলিমুল হকের সঙ্গে এমপি মোস্তাফিজুর রহমানের দূরত্ব ঘোচেনি। যার জের ধরে সেলিম এবার পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাননি। গত রোববার (১৬ জানুয়ারি) বাঁশখালী পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন স্থানীয় সাংসদ মোস্তাফিজুরের আস্থাভাজন এসএম তোফাইল বিন হোসাইন।
সিপি







