চট্টগ্রামের কলেজে শিক্ষার্থীদের টাকা নেতাদের পকেটে, ‘প্রতারক’ খোঁজার নাটকে ছাত্রসংসদ

চট্টগ্রামের ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষার্থীদের ফরমফিলাপের টাকা মেরে খাওয়ার ঘটনায় বাঁচতে গিয়ে ফের সমালোচনার মুখে পড়েছেন ছাত্র সংসদের নেতারা। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাত্রসংসদের কেউ নয় বলে বিজ্ঞপ্তি দিলেও প্যাডের বাম পাশে কমিটির ১৬ জনের তালিকায় রয়েছে ওই ‘প্রতারকের’ নামও। এ যেন চোরকে সঙ্গে নিয়েই চোর খোঁজা।

এর আগে ইসলামিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ১৪৮ শিক্ষার্থীর ফরমফিলাপের টাকা মেরে খান ইসলামিয়া কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজীব শীল। একইসঙ্গে অনার্স ও ডিগ্রি (পাস) কোর্সের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থীকে ‘কম টাকায়’ ফরমফিলাপের কথা বলে টাকা হাতিয়ে নেন কলেজ ছাত্রসংসদের সমাজসেবা ও আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক মো. আরাফ চৌধুরী।

কিন্তু পরে অবস্থা বেগতিক দেখে ডিগ্রির শিক্ষার্থীর টাকা ফেরত দিলেও অনার্সের প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থীর টাকা মেরে দেন আরাফ। জনপ্রতি প্রায় ১১ থেকে ১২ হাজার টাকা করে হিসেব করলে আত্মসাৎ করা টাকার অংক দাঁড়ায় প্রায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি।

ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে আরাফের টাকা মেরে খাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।

টাকা মেরে খাওয়া দুই নেতা—রাজীব শীল ও মো. আরাফ চৌধুরী চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক মো. শাহরিয়ার হাসানের অনুসারী বলে জানা গেছে।

এসব ঘটনার পর ১ জুলাই কলেজ ছাত্রসংসদের প্যাডে সহ-সভাপতি (ভিপি) ফয়সাল সাব্বি ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সৈয়দ ইবনে জামান ডায়মন্ড স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, সংসদের নাম ব্যবহার করে কিছু অসাধু ছাত্রনেতা সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা আত্মসাৎ করেছে। এদের সাথে ছাত্র সংসদের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতারিত হওয়ার কোনো তথ্য-প্রমাণ কারও নিকট থাকলে তা ছাত্রসংসদের ভিপি ও জিএস বরাবরে পাঠাতে বলা হয়।

‘সম্পর্ক’ না থাকার কথা বলা হলেও বিজ্ঞপ্তির বাম পাশে সংসদের প্যাডে ১৬ জনের কমিটির সদস্যদের যে তালিকা রয়েছে, সেখানেই সমাজসেবা ও আপ্যায়ন বিষয়ক সম্পাদক মো.আরাফ চৌধুরীর নামও ছিল।

ছাত্রসংসদের ভিপি ও জিএসের দাবি, ‘সে (আরাফ) ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের টাকা দিয়ে দিয়েছে।’

টাকা মেরে পরীক্ষাই দেননি আরাফ

অভিযুক্ত আরাফ চৌধুরী নিজেও অনার্স ফাইনালের পরীক্ষার্থী। সতীর্থদের ফরমফিলাপের টাকা কমিয়ে দেওয়া কথা বলে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১১-১২ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। সে হিসেবে টাকার পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় পাঁচ লাখ টাকার বেশি। কিন্তু এ ঘটনার পর আরাফ নিজেই ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। এমনকি কলেজের সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ভুক্তভোগীরা তার বাসায় গেলে, সেখানেও তাকে পাওয়া যায়নি।

আরাফকে না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ভিপি ফয়সাল সাব্বি বলেন, ‘তার (আরাফ) মা মারা যাওয়ায় গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছে সে।’

যেভাবে শিক্ষার্থীর টাকা নেতাদের পকেটে

নেতাদের খপ্পরে পড়ে টাকা খোয়ানো একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, ইসলামিয়া কলেজের ভর্তি ফি, ফরমফিলাপের ফি তুলনামূলক বেশি। ফলে ছাত্রলীগ বা ছাত্রসংসদের নেতাদের কাছে ধরণা দেয় শিক্ষার্থীরা। কারণ এসব নেতাদের মাধ্যমে টাকা জমা দিলে কয়েক হাজার টাকা কম খরচ হয় তাদের। এরপর নেতারা প্রভাব খাটিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি করে যা কমাতে পারে, তাই তাদের পকেটে যায়।

অনার্সের এক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমি প্রথমবর্ষ থেকেই আরাফকে দিয়ে ভর্তি ও ফরমফিলাপ করি। এবারও তাকে সাড়ে ১১ হাজার টাকা দিই, অনেকে ১২ হাজার টাকা করে দিয়েছে। কলেজ যে পরিমাণ টাকা চায়, আরাফ তার থেকে হাজার পাঁচেক টাকা কম দিয়ে কাজ করে দেয়। তবে এবার সে বিপুল পরিমাণের একটা টাকা মেরে লাপাত্তা হয়ে যায়। এখনও আমরা টাকা ফেরত পায়নি। নেতাদের বলেও কোনো লাভ হয়নি।’

এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা মোরশেদ বলেন, শিক্ষার্থীদের টাকা জমা দেওয়ার জন্য ব্যাংক ও রকেট মোবাইল ব্যাংকিং রয়েছে। কেউ যদি এর বাইরে গিয়ে নেতাদের কাছে টাকা দেয়, তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘কোনো নেতার ক্ষমতা নেই টাকা কমানোর। শিক্ষার্থীরা এক বছরের টাকা একসঙ্গে পরিশোধ করতে গিয়ে বিপত্তির শিকার হয়। তখন এটি তাদের কাছে বেশি মনে হয়।’

জেনেও না জানার ভান নেতাদের

অনার্সের শিক্ষার্থীদের টাকা আত্মসাতের ঘটনার পর সবার চোখ ছাত্রসংসদের ভিপি ও জিএসের দিকে। এ বিষয়ে জানতে ভিপি ফয়সাল ও জিএস ডায়মন্ডকে ফোন করা হলে বেরিয়ে আসে আরেক তথ্য। দু’জনই বলেন, ‘আরাফ ডিগ্রির শিক্ষার্থীদের টাকা নিয়েছিল জানতাম এবং পরে সেটা ফেরতও দেয়। তবে অনার্সের বিষয়টি জানা নেই।’

অনার্সের বিষয়টি জানা না থাকার কথা বললেও একাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী বলেন, ‘সংসদের ভিপি মো. ফয়সাল সাব্বির এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন।’

আরাফের বিরুদ্ধে এর আগেও টাকা আত্মসাতের অভিযোগ থাকলেও কেন তার বিরুদ্ধে এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না—এমন প্রশ্নের উত্তরে ভিপি ফয়সাল বলেন, ‘আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। ঘটনার পর সে কলেজে আসছে না এবং কোনো ধরনের যোগাযোগও করছে না। কলেজে আসলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কেন সংসদের পদ থেকে আরাফকে বহিষ্কার করা হচ্ছে না—জানতে চাইলে ভিপি সাব্বির বলেন, ‘আমরা সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেবো।’

একই সুরে কথা বলেন জিএস সৈয়দ ইবনে জামান ডায়মন্ড। তিনি বলেন, ‘অনার্সের বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি সে এই কাজে জড়িত থাকে, তাহলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

তবে ছাত্রসংসদের সভাপতি কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা মোরশেদ বলেন, ‘আরাফের বিরুদ্ধে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে, অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

জরিমানা দিয়েই ফরমফিলাপ

অনার্স চতুর্থ বর্ষের ফরমফিলাপের টাকা জমা দেওয়ার শেষ তারিখের আগেই সমস্ত টাকা জমা দেওয়া হয় আরাফের কাছে। কিন্তু তারিখ চলে যাওয়ার পরও যখন শিক্ষার্থীদের ফরম ফিলআপ করা হয়নি, তখন ভুক্তোভুগীরা কলেজে গিয়ে জানতে পারেন, তাদের কোনো টাকাই কলেজে জমা হয়নি। পরীক্ষা দিতে পারবেন না জেনে অনেক শিক্ষার্থী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর কলেজের অধ্যক্ষ মোস্তফা মোরশেদ জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে বিশেষ অনুমতিতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দেন।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ মোস্তফা মোরশেদ বলেন, ‘যখন জানতে পারি তাদের টাকা অন্য কোথাও আত্মসাৎ হয়েছে, তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুসারে বিশেষ অনুমতিতে পেনাল্টি ফি পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ওদের পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিই।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মো. আরাফ চৌধুরীকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে ক্ষুদেবার্তা দিলেও কোনো উত্তর দেননি। পরে আবারও ফোন করা হলে তার নম্বরটি ওয়েটিং পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি এরপরও কোনো ফিরতি কল করেননি।

‘ছাত্রলীগ টাকা কমাতে পারে না’

কলেজের কোনো শিক্ষার্থীর টাকা কমানোর সুযোগ ছাত্রলীগ বা সংসদের কোনো নেতার নেই বলে জানিয়েছেন কলেজ অধ্যক্ষ মোস্তফা মোরশেদ। শুধুমাত্র দরিদ্র কোনো শিক্ষার্থী নিজে ও অভিভাবকসহ উপস্থিত থাকলে তখনই তার টাকা কমানোর সুযোগ থাকে।

এ বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ‘এ পর্যন্ত ইসলামিয়া কলেজের কোনো শিক্ষার্থী টাকার জন্য ফরমফিলাপ করতে পারেনি, এমন নজির নেই।’

কিন্তু নেতার মাধ্যমে টাকা কমিয়েছেন এমন অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থীর নাম উল্লেখ করা যাবে বলে প্রতিবেদক জানালে অধ্যক্ষ বলেন, ‘এমন সুযোগ নেই। অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট ছাড়া অন্য কেউ শিক্ষার্থীর টাকা কমাতে পারে না।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!