চট্টগ্রামেও নতুন কারিকুলামের প্রথম পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস, অভিভাবকদের ক্ষোভ

থাকবে না নম্বর, সাত স্তরের মার্কিং স্কেলে হবে মেধা যাচাই

শিক্ষাজীবনে প্রথমবারের মতো নতুন কারিকুলামের পরীক্ষা দিয়েছে অংকুর সোসাইটি উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী নিরুপমা দেওয়ান (ছদ্মনাম)। বুধবার (৩ জুলাই) বাংলা পরীক্ষা ছিল তার। ১০০ নম্বরের মধ্যে ৩৫ নম্বর ছিল ধারাবাহিক বা হাতে কলমে আর বাকি ৬৫ ছিল লিখিত। তবে নিরুপম পরীক্ষার হলে গিয়ে জানতে পারে, তার অনেক সহপাঠীই আগের দিন প্রশ্নপত্র পেয়েছে। পরীক্ষা শেষে ঘরে এসে নিরুপম তার বাবার কাছে দাবি করে, তাকেও যেন পরবর্তী পরীক্ষার প্রশ্ন এনে দেওয়া হয়।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় এমনই প্রতিক্রিয়া জানান ওই ছাত্রের অভিভাবক।

বুধবার শুরু হয় শিক্ষার্থীদের ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন বা অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষা। আর নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম পরীক্ষাতেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অনেক অভিভাবক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সেই ক্ষোভ ঝেরেছেন।

জানা গেছে, গত বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এই নতুন কারিকুলামের শিক্ষাক্রম চালু হয়। এ বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে শুরু হয় একই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা।

নতুন ধারার এই পরীক্ষা ব্যবস্থায় এ বছর সারাদেশে এক ও অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিচ্ছে প্রায় এক কোটি শিক্ষার্থী। পরীক্ষার আগের রাতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে স্কুলপ্রধানের ই-মেইলে প্রশ্নটি পাঠানো হয়। আর সেই প্রশ্নপত্র পরীক্ষার আগে ডাউনলোড করে ফটোকপি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণের নিয়ম রয়েছে। আর সেই ফাঁকেই কোনো এক শিক্ষকের মাধ্যমে এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এমন অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের সঙ্গে বুধবারের বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের হুবহু মিলও পাওয়া গেছে।

যদিও এনসিটিবি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামানের মতে, প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে প্রশ্ন ও উত্তর লিখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন।

অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান জানান, পরবর্তীতে যাতে এমন ঘটনা না ঘটে, সেজন্য প্রত্যক স্কুলপ্রধানকে জানানো হয়েছে। এরপরও কারও আইডি থেকে তা বাইরে গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে এনসিটিবি’র চেয়ারম্যানের মন্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক অভিভাবক বলেন, ‘ধরেন, আমার মেয়ে প্রশ্ন পেলো না, তার আরেক সহপাঠী পেলো, এখন তারা যখন প্রশ্নগুলো লিখবে তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার মেয়েকে মাথা খাটিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অন্যদিকে যে প্রশ্ন পেয়েছে, সে মুখস্থ লিখে যাবে। পরবর্তীতে ফলাফলের সময় আমার মেয়ের মেধা ওই শিক্ষার্থীর কাছে হেরে যাবে।’

‘যেহেতু কারিকুলামটি এই প্রথম এসেছে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী এমনকি শিক্ষকরাও এই সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত না, ওনারা নিজেরাই বুঝেন না। তাই এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষের আরও বেশি নজরদারি ও আন্তরিক হতে হবে’— বলেন ওই অভিভাবক।

নম্বর নয়, থাকবে ‘সাত স্তরের মার্কিং স্কেল’
নতুন শিক্ষানীতির পরীক্ষার মূল্যায়নেও রয়েছে ভিন্নতা। আগে যেরকম নম্বরের ওপর একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করা হতো, এবারের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই সে পদ্ধতি।

এবার শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ে থাকবে সাত স্তরের মার্কিং স্কেল। এমনকি শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নের সময়ও কোনো ধরনের নম্বর প্রদান করবেন না। নির্দিষ্ট কিছু চিহ্নের মাধ্যমেই মেধার ক্রম নির্ধারণ করতে হবে।

পরবর্তীতে শিক্ষকদের দেওয়া সেই চিহ্ন নির্দিষ্ট একটি অ্যাপে দেওয়ার পরে ওই অ্যাপটি একজন শিক্ষার্থীর মান যাচাই করে তা প্রকাশ করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলেন, ‘প্রথম প্রথম কিছু না কিছু ক্রুটি থাকবে। যা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তবে এটা ঠিক আমাদের ৮০ শতাংশ শিক্ষকই এই কারিকুলামে অভ্যস্ত না। এমনকি তারা কিভাবে পাঠদান করবেন, তাও সঠিকভাবে জানেন না।’

প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ প্রশ্নপত্র পেলেও তেমন একটা লাভ হবে না। কেননা তারা তো পরীক্ষাতে বই নিয়ে যেতে পারে, এমনকি বই দেখেও লিখতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে তাদের যে প্রশ্নগুলো করা হয়, সেগুলোর উত্তর বইতে থাকবে না। তাদের উত্তর দিতে হবে মাথা খাটিয়ে। তাই প্রশ্ন ফাঁস হলেও তেমন একটা অসুবিধা নেই। তবে ফাঁস হওয়ার কারণে প্রভাব তো কিছু পড়বেই। মাত্রই প্রথম পরীক্ষা হলো, আর কিছুদিন পর দেখবেন বিভিন্ন গাইড, নোট দোকানে কিনতে পাওয়া যাবে। যেখানে প্রশ্নের ধারণা ও উত্তর দুটোই দেওয়া থাকবে। তখন আর বিষয়গুলো ততটা কঠিন মনে হবে না।’

বিএস/ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!