s alam cement
আক্রান্ত
১০২২৪৫
সুস্থ
৮৬৮৫৬
মৃত্যু
১৩২৫

চট্টগ্রামের কারারক্ষীর জবানিতে জেলে ৪ নেতা খুনের রুদ্ধশ্বাস বয়ান

মদ খেয়ে ভেতরে ঢোকে সশস্ত্র খুনিরা, প্রস্তুতি শুরু রাত ২টা থেকে

0

কলঙ্কিত জেল হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হয়েছিল রাত সাড়ে ৩ টা থেকে ৪ টার মধ্যে। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই হত্যার প্রস্তুতি শুরু হয় তারও দেড় ঘন্টা আগে। অর্থাৎ রাত দুইটায়। হঠাৎ করেই সেদিন রাত দুইটায় জেলের পাগলা ঘন্টা বাজানো হয়। কারাগারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কারারক্ষীদের বলে দেওয়া হয় যা ঘটবে তা চোখে দেখা আর কানে শোনা ছাড়া কিছুই করা যাবে না।

দিনটি ছিল ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। সেই দিনটিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কারাগারের মতো কঠোর নিরাপত্তা প্রকোষ্ঠে এ ধরনের নারকীয় হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন।

ইতিহাসের কলঙ্কিত সেই হত্যাকাণ্ডের সরাসরি সাক্ষী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সেই সময়কার কারারক্ষী কাজী আব্দুল আলীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে খোলাখুলি জানিয়েছেন সেদিনের মর্মন্তুদ ঘটনার চোখে দেখা বয়ান।

কাজী আব্দুল আলীমের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার সারিকাইত ইউনিয়নে। ৭১ বছর বয়স্ক মানুষটি বর্তমানে অবসর জীবন যাপন করছেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কাজী আব্দুল আলীম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকে দায়িত্ব পালন করছিলেন। তার সামনে দিয়েই খুনিরা কারাগারের ভেতর প্রবেশ করে। হত্যাকাণ্ড শেষে আবার চলেও যায় কাজী আব্দুল আলীমের চোখের সামনে দিয়ে।

চট্টগ্রামের কারারক্ষীর জবানিতে জেলে ৪ নেতা খুনের রুদ্ধশ্বাস বয়ান 1

রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যেই একটি খোলা জিপে করে ৪ জন সেনাসদস্য সশস্ত্র অবস্থায় কারাফটকে আসেন। তাদের তিনজন ভেতরে প্রবেশ করেন। এসময় তারা তিনজনই মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। ভেতরে ঢুকে দ্রুত হত্যাকাণ্ড শেষ করে চলেও যান তারা। তবে কিছুক্ষণ বাদে আবার ফিরে আসেন। কারণ কারাগারের ভেতর থেকেই কেউ তাদের জানিয়েছিল ৪ নেতার একজন বেঁচে আছেন তখনও। সেই খবর পেয়ে ফিরে এসে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তখন পর্যন্ত বেঁচে থাকা এএইচএম কামরুজ্জামানের হত্যা নিশ্চিত করেন তারা। জেলের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত থাকলেও তাদের কোনো বাধা না দেওয়ার নির্দেশ ছিল উপরমহল থেকে। সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে শেষবারের মত জেলের ভেতর জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যা না করার অনুরোধ জানিয়ে সেনাসদস্যদের হাতে মার খেতে হয় তৎকালীন ডিআইজি প্রিজন কাজী আব্দুল আওয়ালকে।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে কাজী আব্দুল আলীম বলেন, ‘হত্যাকারীরা রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে জেলের ভেতর ঢোকে। আমাদের প্রতি ওপরের নির্দেশ ছিল কোন টু শব্দ করা যাবে না। শুধু চোখে দেখবা কানে শুনবা। কোন প্রশ্ন করতে পারবে না। এজন্য আমরা প্রশ্ন করতে পারি নাই।’

এ সময় কারাগারের উর্ধতন কর্মকর্তারা কারাফটকে উপস্থিত ছিলেন জানিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, ‘উর্ধতন কর্মকর্তা সবাই উপস্থিত ছিলেন। ডিআইজি আব্দুল আউয়াল সাহেব, জেলার শামসুর রহমান সাহেব আর ৩ জন ডেপুটি জেলার ছিলেন। উনারা সবাই আগে থেকে জানতেন হয়তো। তবে আমরা যারা কারারক্ষী ছিলাম আমরা কিছুই জানতাম না।’

চট্টগ্রামের কারারক্ষীর জবানিতে জেলে ৪ নেতা খুনের রুদ্ধশ্বাস বয়ান 2

হত্যার প্রস্তুতি শুরু হয় রাত ২টা থেকে

সেদিন রাত ২টা থেকেই জেলের ভেতর হত্যার প্রস্তুতি শুরু হয় জানিয়ে কারারক্ষী কাজী আব্দুল আলীম বলেন, ‘রাত দুটার দিকে পাগলা ঘন্টা বাজানো হয়েছিল। ৪ নেতার মধ্যে তিনজন এক কক্ষে ছিলেন, অন্যজন আলাদা কক্ষে। উনাদের সবাইকে এক কক্ষে আনা হয় খুনিরা কারাগারে ঢোকার আগেই।’

তিনি বলেন, ‘হঠাৎ কারাঘন্টা বাজানো হয়। আমরা মনে করেছিলাম ভেতরে কোনো ঝামেলা হয়েছে। তখনও আমরা কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।’

সেই রাতে ২ টায় কারাফটকে দায়িত্ব নেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কারাগারে নির্দিষ্ট সময় পর পর ডিউটি বদল হয়। ওদিন রাত ২ টায় আমি মূল গেইটে ডিউটি পাই আরেকজনসহ। এর বাইরে সেদিনের জন্য শুধু আরও বেশ কিছু বাড়তি কারারক্ষী মূল ফটকের আশপাশে ডিউটিতে ছিল। আমাদের বলে দেওয়া হয় যা হবে টু শব্দ করা যাবে না। শুধু চোখে দেখবা আর কানে শুনবা।’

মদ খেয়ে ভেতরে ঢোকে সশস্ত্র খুনিরা

আব্দুল আলীম বলেন, ‘রাত ৩ টা থেকে সাড়ে ৩ টার মধ্যে একটা খোলা জিপে করে ৪ জন কারাফটকে আসে। তাদের মধ্যে একজন জিপেই বসে ছিল। বাকি ৩ জন ভেতরে ঢোকে। তারা ছিল সশস্ত্র আর মদ খাওয়া। একদম লোড অবস্থায় ছিল।’

খুনিরা মুখোশপরা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা মুখোশপরা ছিল। কিন্তু দুজনকে চিনতে পারি— কর্নেল ফারুক আর মেজর ডালিম। কারণ তাদেরকে আমি চিনতাম। তারা আগেও বিভিন্ন সময়ে কারাগারে এসেছিলেন। আধঘন্টা পর তারা বের হয়ে চলে যায়। তারা ভেতরে থাকতে আমরা ব্রাশফায়ারের আওয়াজ শুনি।’

একবার চলে গিয়ে আবার ফিরে আসে খুনিরা

প্রথম দফায় তাণ্ডব চালিয়ে চলে যাওয়ার পর খুনিরা কিছুক্ষণ বাদে আবার ফিরে এসেছিল জানিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, ‘প্রথমবার ব্রাশফায়ার করে চলে যাওয়ার পর আবার তারা ফিরে আসে। কারাগারে প্রবেশ করে। কিছুক্ষণ পর আবার চলে যায়। পরে শুনেছি প্রথমবার তারা চলে যাওয়ার পর কামরুজ্জামান সাহেব চৌকি থেকে লাফিয়ে নিচে পড়েন। তিনি তখনও জীবিত ছিলেন। সম্ভবত ভেতর থেকে এই খবরটা খুনিদের কেউ দিয়েছিল। সেই খবর পেয়ে তারা ফিরে আসে। ভেতরে ঢুকে তারা বেয়নেট দিয়ে কামরুজ্জামান সাহেবকে কয়েকটা ঘাই মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করে।’

বাধা দেওয়ায় মার খান ডিআইজি প্রিজন

হত্যাকাণ্ডের আগ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া এবং কারারক্ষীদের চুপচাপ সব দেখার নির্দেশ দেওয়ার ধরন থেকে এটা স্পষ্ট যে কারা কর্তৃপক্ষ আগে থেকে বিষয়টি জানতো এবং রাষ্ট্রের ওপরমহল থেকে এই বিষয়ে তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল। তবু কারাগারে ভেতরে প্রবেশ করার পর ডিআইজি প্রিজন খুনিদের অনুরোধ করেছিলেন ৪ নেতাকে কারা অভ্যন্তরে হত্যা না করতে। এর প্রেক্ষিতে তাকে খুনিরা ঘুষি মারার পর আর কেউ কোনো কথাই বলেনি। নিঃশব্দে ৪ নেতার কক্ষে প্রবেশ করে ব্রাশফায়ার করে খুনিরা।

আব্দুল আলীম বলেন, ‘ডিআইজি সাহেব খুনিদের বলেছিলেন কাগজপত্র তৈরি করে আপনারা উনাদের কারাগার থেকে বাইরে নিয়ে যান। কারাগারের ভেতর কিছু করবেন না। সাথে সাথে উনাকে ঘুষি মারে এক খুনি। এরপর আর কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি।’

তিনি বলেন, ‘সেদিন ৪ টায় আবার নিয়মমত আমাদের ডিউটি বদল হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেই ঘটনার পর আর বদলি হয়নি। যে যেখানে ছিল সেখানেই ডিউটি চলে। এমনকি পরের দিন কোন ওয়ার্ডের তালাও খোলা হয়নি। পরেরদিন সকাল ১০ টার দিকে একটা টেলিগ্রাম প্রচার হয়— যার মাধ্যমে আমরা প্রথম জানতে পারি কারাগারের ভেতর ৪ জন নেতা আততায়ীর হাতে খুন হয়েছেন।’

এই ঘটনার ৩-৪ বছর পর সিআইডি কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আকন্দের (পরে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক) কাছে এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সাক্ষী দিয়েছিলেন জানিয়ে আব্দুল আলীম বলেন, ‘প্রায় ৩-৪ বছর পর সিআইডি কার্যালয়ে আমাকে ডাকা হয়। দুই দফা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিআইডি অফিসার আব্দুল কাহার আকন্দ। আমি যা জানতাম সবই উনাকে জানিয়েছি।’

সিপি

ManaratResponsive

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm