s alam cement
আক্রান্ত
১০১৪৩৬
সুস্থ
৮৬৩০২
মৃত্যু
১২৮৪

চট্টগ্রামের পাহাড়ে লোভের কোপ, অল্প জরিমানায় দায় সারছে পরিবেশ

কোটি টাকার পাহাড় কেটে জরিমানা হয় লাখ টাকা মাত্র

0

চট্টগ্রাম নগরীতে পাহাড়কাটা আর তার বিপরীতে অভিযানের যে কায়দা— সেই দৃশ্যপট অনেকটাই বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো। টানটান উত্তেজনায় সিনেমার শেষাংশে এসে ভিলেনকে ধরতে পুলিশ গিয়ে হাজির হয়। পাকড়াও করা হয় ভিলেনকে।

তবে বাংলা সিনেমার প্রায় সব গল্পেই এমন পরিণতি দেখা গেলেও চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাহাড় কাটার অভিযানগুলো খানিকটা আলাদা। ভিলেনকে পাকড়াও না করার বদলে দিয়ে আসা হয় আইনি নোটিশ। পরদিন অফিসে এসে মোটামুটি অংকের একটা জরিমানা গুণেই পাহাড়খেকোর খালাস মেলে। জরিমানা শোধের পর আবার চলতে থাকে পাহাড়কাটা। কোটি কোটি টাকার সম্পদ ভোগ করার বিপরীতে লাখ টাকার জরিমানা গায়েই মাখে না পাহাড়খেকোরা। আর অনেক ক্ষেত্রে জরিমানা গোণার অনেক আগেই পাহাড় মাটিতে মিশিয়ে ফেলে গড়ে তোলা হয় আবাসস্থল কিংবা বাণিজ্যিক স্থাপনা। আর পাহাড় কেটে সমতল বানিয়ে ঘর-বাড়ি তুলে ফেললেও সেই খবর চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তর জানতে পারে না। যখন জানতে পারে, তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে পাহাড় কেটে তৈরি হয়ে গেছে স্থাপনা। এই অপরাধে একটা জরিমানা করেই তারা দায় সারে।

সংক্ষেপে এই হল চট্টগ্রামের প্রভাবশালী পাহাড়খেকো আর পরিবেশ অধিদপ্তরের চোর-পুলিশ খেলার কাহিনী। দেখা গেছে, এমনই লুকোচুরির খেলায় পড়ে চট্টগ্রাম নগরীর খুলশীতে অবস্থিত পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যালয়ের মাত্র দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার এলাকায় কেবল গত দুই বছরেই কাটা হয়েছে অগণিত ছোট বড় পাহাড় ও টিলা।

চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস এলাকায় বাটালি হিল এলাকার মিঠা পাহাড়ের উত্তর পাশে বিন্না ঘাসের পাইলট প্রকল্পের জন্য পাহাড় কেটে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও। গত ২৬ জানুয়ারি মিঠা পাহাড় কাটায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে জরিমানা করা হয় মাত্র ১২ হাজার ২০০ টাকা।
চট্টগ্রাম নগরের টাইগারপাস এলাকায় বাটালি হিল এলাকার মিঠা পাহাড়ের উত্তর পাশে বিন্না ঘাসের পাইলট প্রকল্পের জন্য পাহাড় কেটে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনও। গত ২৬ জানুয়ারি মিঠা পাহাড় কাটায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে জরিমানা করা হয় মাত্র ১২ হাজার ২০০ টাকা।

পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, পাহাড় কাটার অভিযোগে ২০২০ সালে মামলা করা হয়েছে ৩১২টি। ২০২১ সালের জুলাই পযন্ত মামলা করা হয়েছে ১৬৮টি।

চট্টগ্রাম নগরীর ফয়েজ লেক সংলগ্ন স্পাইসি সড়কের পাশে পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হয়েছে স্থাপনা। প্রায় ১ বছরের বেশি সময় ধরে কাটা হচ্ছিল স্পাইসি সড়কের পাশে পাহাড়তলীর মৌজার পাহাড়টি। পাহাড় কেটে স্থাপনা বানিয়েছেন ওমর ফারুক নামের এক ব্যক্তি। মৌজা পাহাড়তলীর লট-৯ (বিএস দাগ নং-১২১)-এর শূন্য দশমিক ৬ একর জমির মালিকানা দাবিদার ওমর ফারুক ৫০০ বর্গফুট পাহাড়ের জায়গা কেটে সমতল ভূমি তৈরি করেছেন।

Din Mohammed Convention Hall

নির্বিবাদে পাহাড় কাটা যখন শেষ, তখন সেই খবর কানে যায় চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তরের। শেষমেশ গত ১৬ জুলাই পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টিম নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে সাথে নিয়ে গিয়ে ওমর ফারুককে যথারীতি আইনি নোটিশ দেয়। জরিমানা করে ২ লাখ ২৫ টাকার টাকা। ওমর ফারুকও স্বল্প ওই জরিমানার টাকা পরিশোধ করে পাহাড় কাটার দায় থেকে মুক্তি পান খুশি মনেই।

ওমর ফারুকের পাশেই পাহাড় কেটে সমতল করেছেন জাফর আহমেদ নামের আরেক লোক। বিএস ১২১ নং দাগের শূন্য দশমিক ০৩ একরের মালিকানা দাবিদার জাফর আহমেদ ৪৫০ বর্গফুট পাহাড়ের জায়গা কেটে সমতল করে তৈরি করেছেন টিনের ছাউনিঘেরা ঘর। জানা গেল, গত ১৬ জুলাই একই দিনে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টিম ঘটনাস্থলে গিয়ে জাফর আহমেদকেও ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। পরদিনই জাফর আহমেদ জরিমানার সেই টাকা পরিশোধ করে এসেছেন।

জাফরের জায়গার পাশেই নূরুল আবছার নামের আরেক ব্যক্তি পাহাড় কেটে ৬০০ বর্গফুট জায়গা বের করে সমতল করে ফেলেছেন। তাকে জরিমানা করা হয়েছে ৩ লাখ টাকা। তিনিও জরিমানার টাকা পরদিনই পরিশোধ করেছেন।

পাহাড় কাটার এই তিনটি ঘটনাতেই চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (চট্টগ্রাম মহানগর) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী এক মাসের মধ্যে পাহাড়-টিলায় মাটি ভরাট করে বৃক্ষরোপণ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু জরিমানার দুই মাস পর গত মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, পাহাড়টি কেটে পুরো সমতল করে ফেলেছেন ওমর ফারুক, নূরুল আবছার ও জাফর আহমেদ নামের স্থানীয় ওই তিন ব্যক্তি। ওমর ফারুকের জায়গাটিতে ঘর তুলে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। পাহাড় কেটে তিনি আবার নিচের দিকে ঢালু করে নিয়েছেন, যাতে ভবিষ্যতে সেদিক দিয়ে চলাচলের রাস্তা তৈরি করা যায়। আর কাটা পাহাড়ে গাছপালার অস্তিত্ব তো দূরের কথা, টিলার যেটুকু এখনও একটু দাঁড়িয়ে আছে, সেটিতেও বুলডোজারের কোপ স্পষ্ট। মাটি কেটে পুরোপুরি সমতল করে ফেলা হয়েছে। পাহাড়ের নিচে যেসব গাছ ছিল, সেসব কেটে ওঠানামার জন্য বানানো হয়েছে মাটির সিঁড়ি।

চট্টগ্রামে পরিবেশ অধিদপ্তরের পাহাড় কাটার সব অভিযানেই দেখা যায় একই দৃশ্য। পাহাড় কেটে সমতল করার পরই ঘটনাস্থলে হাজির হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের টিম। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে পাহাড় কেটে সমতল করা হলেও সেই খবর তাদের জানা থাকে না। অথবা জেনেও না জানার ভান করে। পরিবেশ অধিদপ্তর যখন পাহাড় কাটা পরিদর্শনে গিয়ে জরিমানা করে, ততোদিনে পাহাড়ের যা ক্ষতি হওয়ার সেটা হয়ে যায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়খেকো এক প্রভাবশালী ব্যক্তি জানান, পাহাড় কাটতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই। বড় কোনো সমস্যাও হয় না। জরিমানা হয় বড়জোর। যেখানে জায়গার দাম কয়েক কোটি টাকা, সেখানে লাখ টাকার জরিমানায় কিছু যায় আসে না। আর মামলা হলেও তা সাক্ষীর অভাবে বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকে।

পাহাড় কাটার আগাম তৎপরতার খবর কিংবা পাহাড় কাটা চলাকালীন খবর জানতে না পারার ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিচালক (মহানগর) মোহাম্মদ নূরুল্লাহ নূরী। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘পাহাড় কাটার ঘটনা প্রায়ই ঘটে। আমরা খবর পাই দেরিতে। খবর পেলে গিয়ে তদন্ত করি।’

এজন্য লোকবল স্বল্পতাকে দায়ী করে তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামে ৩৭ জনের মধ্যে কর্মরত রয়েছে মাত্র ৮ জন। এর মধ্যে পরিচালক ১ জন, উপ-পরিচালক ১ জন, সহকারী পরিচালক ২ জন, সিনিয়র কেমিস্ট ১ জন, কেমিস্ট ২ জন। পরিদর্শক রয়েছেন ৪ জন।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নগরীর চট্টেশ্বরী সার্কেলের এপিক প্রপার্টিজের মালিক কাজী মো. আরিফ নিকটবর্তী পাহাড়টি কেটে তার আবাসন প্রকল্পের সীমানা বাড়িয়ে নিয়েছেন। পাহাড় কাটার কাজটি তিনি শেষ করেন গত বছরের মাঝামাঝিতে। কিন্তু পরিবেশ দপ্তর সেই খবর পেয়েছে চলতি বছরের ১০ মার্চ। এই অপরাধের জন্য জরিমানা করা হয় মাত্র ১০ হাজার টাকা। ২১ মার্চ এপিক প্রপার্টিজের মালিক জরিমানার সেই টাকা শোধ করে দায় মুক্ত হয়েছেন।

এপিক সেবারই প্রথম, এমন কাণ্ড করেছে আগেও। নগরীর চকবাজার এলাকার পার্সিভ্যাল পাহাড় কাটার পর এপিক কর্তৃপক্ষকে ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবর মাত্র ৯৬ হাজার টাকা জরিমানা করেই দায় সারে পরিবেশ অধিদপ্তর।

বায়েজিদ বোস্তামী জালালাবাদের মহানগর আবাসিক এলাকায় প্রায় এক হাজার বর্গফুট পাহাড় কেটে পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি করলেও চট্টগ্রামের আরেক আবাসন প্রতিষ্ঠান সানমার প্রপার্টিজ লিমিটেডকে গত বছরের ৪ নভেম্বর মাত্র দুই লাখ টাকা জরিমানা করেই ক্ষান্ত হয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এই বায়েজিদেরই চন্দ্রনগর এলাকার গ্রিন ভিউ আবাসিকের পাশে নাগিনী পাহাড় কেটে বহুতল ভবন তৈরি করছিলেন পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক রিতেন কুমার সাহা। পূর্ব নাসিরাবাদ মৌজার নাগিনী পাহাড়ের ৬ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটার এই অপরাধ প্রমাণের পর পরিবেশ অধিদপ্তর গত বছরের ১ জুন ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে মাত্র ছয় লাখ টাকা জরিমানা করেই দায় সেরেছে।

চট্টগ্রাম নগরীর কাতালগঞ্জ এলাকায় পাহাড় কেটে ১৮ তলা আবাসিক ভবন তৈরি করেছে ফিনলে প্রপার্টিজ লিমিটেড। ২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর এক অভিযানে পরিবেশ অধিদপ্তরের টিম পাহাড় কাটার প্রমাণ পেলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।

চট্টগ্রামের খুলশী থানার লালখানবাজার মতির্ঝণা এলাকায় পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে তিন তলা ভবন গড়ে তোলেন শাহজাহান কোম্পানি নামের এক ব্যক্তি। ভবন ওঠার পর হুঁশ হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের। প্রায় ১৪ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটার দায়ে গত বছরের ৩ নভেম্বর ওই লোককে ১৪ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

আবার নাসিরাবাদ মোহাম্মদীয়া জামে মসজিদ সংলগ্ন চৌধুরী নগরে মামুন নামের এক ব্যক্তি পাহাড় কেটে স্থাপনা তৈরি করেছেন। তার সেই পাহাড় কাটা গত বছরের শেষদিকে সম্পন্ন হলেও চলতি বছরের ১৭ জুলাইয়ে এসে পাহাড় কাটার অভিযোগে তাকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করে চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর।

একইভাবে নগরীর বায়েজিদ খামারবাড়ি এলাকায় মাওলানা ইসমাইলকে পাহাড় কাটার অভিযোগে ২১ জুলাই ২ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তার দুইদিন পরেই মাওলানা ইসমাইল জরিমানার টাকা শোধ করেন।

পাহাড় কাটার আগাম তৎপরতার খবর জানতে চট্টগ্রামের পরিবেশ অধিদপ্তরে ‘গোয়েন্দা শাখা’ গঠন করার প্রয়োজনীয়তার কথা জানান উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, গত বছর ঢাকা থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুমায়ুন কবির চট্টগ্রামে আসলে আমরা তাকে এ সমস্যার কথা জানাই। তিনি তখন জানান, খুব তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন।

মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, আমরা সবসময় পাহাড় কাটার পরেই যাই, তা ঠিক না। অনেক সময় পাহাড় কাটা চলার সময়েও যাই। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয় না। পাহাড় যা কাটার তা হয়েই যায়।

সিপি

ManaratResponsive

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm