চট্টগ্রামে কাস্টমস কর্তার প্রশ্রয়ে লোক ঠকানোর বাণিজ্যে সিএন্ডএফ এজেন্ট

কৌশলে ফাঁদে ফেলা হয় আমদানিকারকদের

চট্টগ্রামের কাস্টমস হাউসের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মামুনুর রহমান। কাস্টমসের নিলাম, পণ্য ছাড়িয়ে নেওয়া থেকে শুরু করে আমদানিকারকদের পণ্য সহজে কাস্টমস থেকে বের করার ‘ক্ষমতা’ রয়েছে তার। এজন্য তিনি ব্যবহার করেন ভাই রাশেদুল আলমের নাম। রাশেদুল কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও)। তবে রাশেদুল ছাড়াও একই পদে ফরিদুল আলম নামের এক চাচাও আছেন মামুনুরের। মূলত এ দুই কর্মকর্তার নাম বেচে দিনের পর দিন ব্যবসায়ীদের প্রতারণা ফাঁদে ফেলছেন মামুনুর। আমদানি করা পণ্য ও নিলামের পণ্য বের করে দেওয়ার নাম করে অন্তত ২০ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে প্রায় শত কোটি টাকা মামুনুর হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতারণার দায়ে কয়েকবার জেল খাটলেও এখনও পুরোদমে লোক ঠকানোর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

জানা গেছে, আমদানিকারক ও যেসব ব্যবসায়ী নিলামে কাস্টমস থেকে পণ্য কিনেন তাদের টার্গেট করেন মামুনুর। আমদানিকারকদের অল্প সময়ের মধ্যে পণ্য বের করে দেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি। বিশ্বাস বাড়াতে পরিচয় দেন কাস্টমসের এআরও ভাই রাশেদুল আলম ও চাচা ফরিদুল আলমের। আমদানিকারকদের কাছ থেকে নিয়ে নেন এলসির মূল কাগজ এবং অগ্রিম টাকা। এরপর টাকা নিয়ে নিলেই শুরু হয় কাজে গড়িমসি। এভাবে বেকায়দায় ফেলে আমদানিকারকদের কাছ থেকে হাতানো হয় টাকা। পরে তার কাছে এলসির কাগজ ও অগ্রিম দেওয়া টাকা ফেরত চাইলে শুরু হয় পণ্য আটকে কাস্টমসের মামলার হুমকি।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কাস্টমসের এআরও ভাই রাশেদুল আলম ও চাচা ফরিদুল আলমের ছত্রছায়ায় মামুনুর এসব কাজ করছেন।

মো. মামুনুর রহমান চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার হোরারবাগ গ্রামের চেয়ারম্যানর বাড়ির মৃত মফিজুর রহমানের ছেলে। তিনি আহনাফ এন্টারপ্রাইজ ও মানিক অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বর্তমানে চকবাজারের চট্টেশ্বরী রোডের ১৩২/২ গাজী শাহ লেনে থাকেন।

জানা গেছে, ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি এলসি নম্বর ১২২৩২০০১০০৩৪ মূলে ৫১ হাজার কেজি পরিমাণ পলিয়েস্টার ইয়ান কাপড় আমদানি করেন ব্যবসায়ী নাসির সিকদার। যার মূল্য ৬৩ হাজার ৩০০ ইউএস ডলার। ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এলসি নম্বর ২৩৫৯০০১০০৩০ মূলে আমদানি করা হয় ৭৪ হাজার কেজি পরিমাণে ডুপ্লেক্স বোর্ড আমদানি করা হয়, যার মূল্য ৫৫ হাজার ৫০০ ইউএস ডলার। মালগুলো সময় মতো ছাড়াতে না পারায় অন্তত ১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয় নাসির সিকদারের। এসব তথ্য উঠে আসে মামুন ও নাসিরের মধ্যকার অঙ্গীকারনামায়।

Yakub Group

২০২০ সালের ৮ অক্টোবর মেসার্স এ আর কে ইমপেক্স লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী নাসির সিকদারের আমদানি করা পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাস করার জন্য একটি অঙ্গীকারনামা চুক্তি করেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মো. মামুনুর রহমান। আমদানি করা পণ্য (এলসি নম্বর ১২২৩২০০১০০১৬) হচ্ছে মেটালিক ইয়ান ১৪ হাজার কেজি। যার বাজারমূল্য ৪২ হাজার ইউএস ডলার। মামুন অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী পণ্য বের করতে না পারায় লোকসান গুনতে হয় ব্যবসায়ী নাসির সিকদারকে।

এছাড়া নাসির সিকদারের আরও ১০টি কনটেইনার এলসি মূলে আমদানিকৃত পণ্যের ডকুমেন্টস মামুনের কাছে গচ্ছিত থাকায় এখনও পর্যন্ত মালগুলো বের করতে পারেননি। যার ফলে প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে তার। বর্তমানে মালামাল তুলতে ছয়টি চেকের বিপরীতে মামুনুর রহমানের বিরুদ্ধে চারটি মামলা আদালতে চলমান রয়েছে।

ঢাকার অংশীদারি তিন ব্যবসায়ী রুবেল, আনোয়ার ও শান্ত। প্রায় ৬ মাস আগে তাদের কাছ থেকে গার্মেন্টসের মালামাল দেওয়ার কথায় কয়েক ধাপে চেকে ও নগদে অগ্রিম ১ কোটি ৪০ টাকা নেয় মামুনুর রহমান। ছয় মাস অতিবাহিত হলেও এখনও পর্যন্ত মালামাল না দিয়ে কালক্ষেপণ করে যাচ্ছেন মামুন। তারা বলেন, ‘মামুনুরের ভাই একজন কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা। মূলত তার এসব কাজের আশ্রয়দাতা তার ভাই।’

এছাড়া ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তার প্রতারণার শিকার হয়েছেন ফার্স্ট জেকেটের স্বত্বাধিকারী মোখলেছুর রহমান। ৪০ কনটেইনার আমদানিকৃত মালামাল যার মূল্য ৭০ লাখ টাকা, এসব পণ্য খালাস করতে অগ্রিম টাকা নেয় মামুনুর। পরে ওই মালামাল খালাস করে দিতে পারেননি তিনি।

এদিকে ২০২০ সালের ২৬ আগস্ট মো. মামুনুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে চট্টগ্রাম নগরীর বন্দর থানা পুলিশ। একই বছরের ৫ অক্টোবর দ্বিতীয়বার বন্দর থানায় গ্রেপ্তার হন তিনি। তার বিরুদ্ধে বন্দর থানায় তিনটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

এছাড়া ১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পাওয়া অনাদায়ে মামুনের বিরুদ্ধে তিনটি চেক প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন চট্টগ্রামের সাতকানিয়া এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মনছুর। মামুনের বিরুদ্ধে চারটি চেকের বিপরীতে মামলা আদালতে দায়ের করেছেন ব্যবসায়ী নাসির সিকদারও।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মো. মামুনুর রহমানকে কল করা হলে রিসিভ করে তিনি শুরুতে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি তার চাচা বলে জানান। এরপর তিনি বলেন, ‘চাচাকে নিয়ে আপনার সঙ্গে বসবো।’

রাশেদুল আলমের পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রতারণা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মামুন নন বলে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অথচ তার ওই নম্বরে কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে ম্যাসেজ আদান-প্রদানের প্রমাণ মিলেছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমস ইপিজেডের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) রাশেদুল আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার ভাই যদি আমার নাম দিয়ে অন্যায় কিছু করে তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। আর কাস্টমস থেকে কোনো কিছু বের করতে হলে সেটা নিয়ম প্রক্রিয়ায় বের করতে হবে।’

দুই ভাইয়ের যোগসাজশে অকশনের পণ্য কেনাবেচা ও ব্যবসায়ীদের আমদানি পণ্য ছাড়ানোর নামে টাকা হাতানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই জানি না। ভুক্তভোগীরা আমার কাছে না এসে কেন সাংবাদিকের কাছে গেল?’

ভুক্তভোগীদের সাংবাদিকের কাছে আসা কী অপরাধ—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আপনাকে বুঝাতে পারিনি। আমি বলছি আমি যেহেতু সরকারি একজন কর্মকর্তা, সেহেতু তারাতো আমাকে জানাতে পারত।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm