দুই কিশোরগ্যাংয়ে অতিষ্ঠ চট্টগ্রামের জামালখান, নেতাদের প্রশ্রয়ে হাতেখড়ি হচ্ছে খুনেও

ফাইভ স্টার ও সাব্বির সেনার আধিপত্যের লড়াই চলছেই

0

চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান-মোমিন রোড-রহমতগঞ্জকে ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় দুটি কিশোর গ্যাং। চট্টগ্রামের ‘সংবাদপত্র পাড়া’ হিসেবে খ্যাত এই এলাকাজুড়ে আধিপত্য বিস্তার ও ক্ষমতার দাপট দেখানোর লড়াইয়ে ব্যস্ত দুই গ্রুপই। এরা নিজেরা আবার বিভিন্ন এলাকার ‘মালিক’ও। এক এলাকায় অন্য গ্রুপের কেউ ঢুকলেও হামলে পড়ে দলবেঁধে।

সম্প্রতি এমন ঘটনার জের ধরে এক কলেজছাত্র খুন হওয়ার পর পুলিশের তৎপরতায় গ্যাং দুটো আপাতত নিশ্চুপ থাকলেও তারা আবার ফিরতে পারে স্বরূপে— এমনই আভাস মিলছে দুই গ্রুপের পক্ষ থেকেই। কারণ দুই গ্রুপের ওপরই ‘বড় নেতা’দের স্নেহমাখা প্রশ্রয় যেমন ছিল আগেও, খুনের ঘটনার পরও গ্যাং সদস্যদের রক্ষায় সক্রিয় এই নেতাদের অনেকে।

২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে অস্ত্র হাতে শোডাউন দেন এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রক সাব্বির সাদিক।
২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে অস্ত্র হাতে শোডাউন দেন এক গ্রুপের নিয়ন্ত্রক সাব্বির সাদিক।

জামালখান-চেরাগীর মোড়-মোমিন রোড ও রহমতগঞ্জকেন্দ্রিক এই দুই কিশোর গ্যাং হচ্ছে— ‘ফাইভ স্টার’ ও ‘সাব্বির সেনা’। কখনও চাঁদাবাজি, কখনও বা আবার এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, কখনও আবার সিনিয়র-জুনিয়রের মতো ঠুনকো বিবাদেও এরা প্রায়ই মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ঘটে মারামারি, দ্বন্দ্ব ও সংঘাত— যার বেশিরভাগই বাইরে সেভাবে জানাজানি হয় না।

সর্বশেষ শুক্রবার (২২ এপ্রিল) রাত ১০টায় জামালখানের আজাদী গলিতে ছুরি মেরে খুন করা হয় কলেজছাত্র আসকার বিন তারেক ওরফে ইভানকে। দুটি কিশোর গ্যাংয়ের দাপট দেখানোর লড়াই থেকেই এই হত্যাকাণ্ড— এখন পর্যন্ত এমনই ধারণা করা হচ্ছে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ মিলিয়ে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের পর বেরিয়ে এলো নেপথ্যের আরও ঘটনা।

নেতাদের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ

জামালখান-চেরাগীর মোড়-মোমিন রোড-রহমতগঞ্জ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপ নামের একটি কিশোর গ্যাং। এরা জামালখানের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের অনুসারী। প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কলেজছাত্র আসকার বিন তারেক ওরফে ইভান খুন হয়েছেন এই গ্রুপের সদস্যদের হাতেই।

শনিবার (২৩ এপ্রিল) ইভানের বাবা এসএম তারেক বাদি হয়ে ধ্রুব (২০), প্রান্ত (২০), শ্রাবণ (২০), শচীন (২০), রুবেল দত্ত (২০), অর্ক (২০) এবং মহান চৌধুরীর (১৮) নাম উল্লেখ করে এবং ১২ জনকে অজ্ঞাতনামা করে হত্যামামলা দায়ের করেন। এরপর পুলিশ শোভন দেব নামের এক কিশোরকেও আটক করেছে। এরা সবাই ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, শৈবাল দাশ, দিগন্ত দে অক্ষয়, মাইনুল ফাহিম, প্রান্ত, রুবেল দত্তের একটি সংঘবদ্ধ দল ছিল বেশ আগে থেকেই। তারা নিজেদের ‘জামালখানের নক্ষত্র’ মনে করতেন। নক্ষত্রের সঙ্গে মিলিয়ে তারা একসময় গ্রুপটির পোশাকি নাম রাখেন ‘ফাইভ স্টার’।

পরে এলাকার স্কুল-কলেজগামী ছেলেদের ‘ক্ষমতার দাপট’ দেখানোর লোভ দেখিয়ে নিজেদের গ্রুপে নিয়ে আসেন তারা। বর্তমানে এই গ্রুপে ১০০ জনেরও বেশি কিশোর সক্রিয় আছে বলে জানা গেছে। এরা জামালখান-চেরাগীর মোড়-মোমিন রোডকেন্দ্রিক যেকোনো মারামারিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে। গ্রুপের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম রুবেল দত্ত নিজেকে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

ফাইভ স্টার গ্রুপের নেতৃত্বে থাকা প্রায় সকলেই এক বা একাধিক মামলার আসামি। গ্রুপের প্রধান সদস্য শৈবাল দাশ ২০১৪ সালে আগ্রাবাদের জাম্বুরি মাঠে রাসেল হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এছাড়া ২০১৬ সালে জামালখান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল কাশেম বাবুলকে হেনস্তা ও হত্যাচেষ্টা মামলারও প্রধান আসামি তিনি।

অভিযোগ আছে, কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের ছত্রচ্ছায়ায় ফাইভ স্টার গ্রুপের সদস্যরা জামালখান এলাকার চেরাগী পাহাড়, আজাদী গলি, বিগ বাজার গলি, লিচু বাগানের একাংশ, চশমা গলি নিজেদের আখড়ায় পরিণত করেছে। এসব স্থানে এই গ্রুপের সদস্যরা বিক্ষিপ্তভাবে সন্ধ্যার পর থেকেই আড্ডায় বসে। জামালখানে কোনো সমস্যা হলেই নিমিষেই সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়।

এছাড়া ফাইভ স্টার গ্রুপের সদস্যদের কাউন্সিলর সুমনের বাসায় আড্ডা মারতে দেখা যায় প্রায়ই। কলেজছাত্র ইভানকে হত্যার আগে ও পরে হত্যাকারীরা কাউন্সিলর সুমনের বাসার নিচে জড়ো হয়েছিল বলে জানা গেছে একাধিক সূত্রে। তবে ঘটনার দিন কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন দেশের বাইরে ছিলেন। পরে চেষ্টা করেও এ বিষয়ে এই কাউন্সিলরের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

রহমতগঞ্জ থেকে মাছুয়া ঝরনায় ‘সাব্বির সেনা’র দৌড়

ফাইভ স্টার গ্রুপের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে জামালখান-চেরাগীর মোড়-মোমিন রোড-রহমতগঞ্জ এলাকায় গড়ে ওঠে আরেক কিশোর গ্যাং— পোশাকি নাম যার ‘সাব্বির সেনা’ গ্রুপ। কথিত ছাত্রলীগ নেতা সাব্বির সাদিকের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া গ্রুপটির প্রধান সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন— মো. শাহজাহান, অমিত, নাবিয়ান এবং জুবায়ের সাহানুর। এদের মধ্যে অমিত ঘটনার দিন নিহত ইভানকে ফোন করে বাসা থেকে ডেকে আনে বলে জানা যায়।

গ্যাং লিডার সাব্বির সাদিক নিজেকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিলেও নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলছেন, সাব্বির সাদিক নামে তাদের কমিটিতে কেউ নেই।

গ্রুপিংয়ের দিক দিয়ে ফাইভ স্টারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয় সাব্বিরের এই গ্রুপ। তবে তাদের আধিপত্য সবচেয়ে বেশি নগরীর রহমতগঞ্জ, জেএম সেন লেইন, দেওয়ানজী পুকুর পাড় ও মাছুয়া ঝরনা এলাকায়। এসব ছোট ছোট এলাকায় নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখতে গিয়ে আগেও একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয় গ্রুপটি।

সাব্বির সেনার সদস্যদের বিরুদ্ধেও রয়েছে একাধিক অভিযোগ। এমনকি চেরাগী এলাকায় ক্ষমতার জোর দেখিয়ে একটি এতিমখানার সম্পত্তি ভাড়া দেওয়ার অভিযোগও পাওয়া গেছে এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে।

গ্রুপের নিয়ন্ত্রক সাব্বির সাদিকের বিরুদ্ধে রয়েছে অস্ত্র মামলাও। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কলেজে গিয়ে অস্ত্র হাতে শোডাউন দেন তিনি। ঘটনার একদিন পর আন্দরকিল্লা থেকে আটক করা হয় তাকে। পরে জেল খেটে বের হয়ে আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন কিশোর গ্যাংয়ের ওপর ভরসা করে।

নিজেদের ‘এলাকায়’ ঢোকার পরিণামে খুন

খুন হওয়ার দুদিন আগে সন্ধ্যায় চার বন্ধুকে নিয়ে কলেজছাত্র ইভান চেরাগী গলির কদম মোবারক স্কুলের সামনের একটি চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় নিজেদের এলাকায় এসে চা খাওয়ার অপরাধে ইভানকে চেয়ার থেকে তুলে দেন ফাইভ স্টার গ্রুপের কথিত লিডার শৈবাল দাশ। ইভান তখন হাতে থাকা চায়ের কাপ সৈকতের দিকে ছুঁড়ে মারেন। এরপর ইভানের সঙ্গে শৈবালের বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনামতে, ওই হাতাহাতির এক পর্যায়ে ইভানকে একটি প্লাস্টিকের চেয়ার দিয়ে মারধর করেন শৈবাল। ঘটনাস্থলে শৈবালের দলের সদস্যসংখ্যা বেশি হওয়ায় কথা না বাড়িয়ে ইভান ও তার বন্ধুরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ইভানরা গিয়ে সাব্বির সেনা গ্রুপের লিডার সাব্বিরকে ঘটনা জানান। সাব্বির বিষয়টি পরে দেখবেন বলে জানান।

তবে ইভান বয়সে ছোট হওয়ায় সেদিনের ঘটনাটিতে অপমানিত হন শৈবাল। এরপর শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) দুই গ্রুপের সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিতে বিষয়টি মীমাংসার জন্য বসলেও উভয়পক্ষ বিচারে সন্তুষ্ট না হয়ে চলে যায়।

এরপর ফাইভ স্টার গ্রুপের অন্যতম সদস্য প্রান্তসহ অন্যদের সঙ্গে নিয়ে কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমনের বাসার সামনে ইভানকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন শৈবাল। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইফতারের পর ইভানকে খুঁজতে থাকে ফাইভ স্টার গ্রুপের সদস্যরা। একপর্যায়ে রাজাপুকুর লেনে ইভানকে পাওয়ামাত্র সেখানেই তাকে কয়েক দফা মেরে চেরাগী মোড়ের আজাদী গলিতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে এনে আবারও মারধর করা হয়। এ সময় ফাইভ স্টার গ্রুপের সদস্য প্রান্ত ছুরি দিয়ে ইভানকে কয়েক দফা আঘাত করে পালিয়ে যান। পরে অবস্থা বেগতিক দেখে ফাইভ স্টার গ্রুপের চার সদস্য ইভানকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে গেলেও তার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।

বিএস/ডিজে/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm