বিধবা বৃদ্ধার জায়গা দখল করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা স্থাপনা তুলছেন সাতকানিয়ায়
আদালতের নির্দেশও মানছেন না, পুলিশও নিরব
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া মির্জাখিলের আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী জীবনের বেশিরভাগ সময়ই জীবিকার তাগিদে প্রবাসে কাটিয়েছেন। প্রায় দুই যুগের প্রবাসজীবনের সঞ্চয়ের টাকায় ২০০৮ সালে সাতকানিয়ার সোনাকানিয়া মৌজায় ৬ শতক জমি কেনেন তিনি। এর প্রায় ৯ বছর পর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী স্ত্রী-সন্তানদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা যে জমি কিনেছিলেন, কে জানতো সেই জমিটাই এক সময়ে চরম ভোগান্তিতে ফেলে দেবে তার বিধবা স্ত্রীকে। স্বামীর কেনা ওই সম্পত্তির অধিকার ধরে রাখতে এখন আব্দুর রাজ্জাকের বিধবা বৃদ্ধা স্ত্রীকে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন আব্দুর রাজ্জাকের স্বজনরা। স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে ওই জায়গা দখলে একটি মহল পাঁয়তারা করছে। এমনকি এর বিরুদ্ধে আদালতে গিয়েও স্থানীয় থানার অসহযোগিতায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন— এমন অভিযোগ করেছেন আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আমেনা বেগম।
আর এক্ষেত্রে স্বামীর নামে নামজারি থাকা জায়গা অবৈধভাবে দখলসহ নানাবিধ হয়রানির অভিযোগে একই এলাকার আখতার হোছাইন মিন্টুকে দায়ী করছেন আমেনা বেগম।
গত ফেব্রুয়ারিতে এই আখতার হোছাইন মিন্টু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা উপ-কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। আমেনা বেগমের অভিযোগ, এর জোরেই তিনি জায়গা দখল ও স্থাপনা নির্মাণে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রে অবৈধভাবে প্রভাব খাটাচ্ছেন। তবে মিন্টু এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, শুধু জায়গা দখলই নয় ওই জায়গাতে এমনভাবে স্থাপনা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তার পাশে থাকা আমেনা বেগমের দুটি দোকানের চলাচলের রাস্তাও একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এমন অবস্থার শিকার হয়ে সেই দুই দোকানও পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। আর এর সবকিছুই হচ্ছে অবৈধভাবে এবং ‘গায়ের জোরে’।
যদিও সেই অভিযোগ অস্বীকার করে আখতার হোছাইন মিন্টু বলছেন, তিনি জায়গা দখল করছেন না বরং নিজের ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আইনি লড়াই করছেন। এক্ষেত্রে আমেনা বেগমের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের বিচার শালিস না মানার অভিযোগ তোলেন আখতার হোছাইন মিন্টু। অন্যদিকে ভুক্তভোগী আমেনা বেগম বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে আখতার হোছাইন মিন্টু একের পর এক হয়রানি করে যাচ্ছেন তাদের।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে আমির হোসেন, আবুল কাশেম, মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ওই ৬ শতক জমি কিনে তা নিজের নামে খতিয়ানভুক্তও করেন আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী। সেই থেকে ওই জায়গাটি ভোগ দখল করছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর আমির হোসেনের ভাই আহমদ হোসেনের ছেলেরা সেই জমির ২ শতকের মালিকানা দাবি করে সে জমির মধ্যে স্থাপনা তৈরির উদ্যোগ নিলে আদালতের দ্বারস্থ হন আমেনা বেগম।

আমেনা বেগমের আবেদনের ভিত্তিতে চলতি বছরের ৭ জুন দুই পক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিতিতে শুনানি শেষে আমেনা বেগম তার স্বত্ব ও দখল প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় আখতার হোছাইন মিন্টুদের বিরুদ্ধে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেন সাতকানিয়ার সিনিয়র সহকারী জজ আদালত মুহাম্মদ ইব্রাহিম খলিলের আদালত।
তবে আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও ওই জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ অব্যাহত রাখেন আখতার হোছাইন মিন্টু— এমনটাই অভিযোগ আমেনা বেগমের। এক্ষেত্রে সাতকানিয়া থানায় দফায় দফায় অভিযোগ করেও প্রতিকার মেলেনি বলেও জানান তিনি।
জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় সরকার ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধের সময়েও চলতে এই নির্মাণযজ্ঞ। এই বিষয়ে আমেনা বেগম থানায় অভিযোগ করলে গত ২ জুন সাতকানিয়া থানার উপপরিদর্শক মো. মাহবুবের নেতৃত্বে একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। তবে তারপরেও কাজ থামেনি এক মুহূর্তের জন্যও।
তখন এসআই মাহবুব আমেনা বেগমকে জানান, আমেনা বেগমদের অনুকূলে দেওয়া নিম্ন আদালতের অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে বিবাদী পক্ষ সংক্ষুব্ধ হয়ে চট্টগ্রাম জেলা জজ কোটে আবেদন করলে জজকোর্ট ওই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ২৬ আগস্ট পর্যন্ত স্থগিত করেছেন। সেই স্থগিত আদেশের কারণে সেখানে স্থাপনা তৈরিতে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই।
এই বিষয়ে আমেনা বেগম বলেন, ‘তারা কতটা প্রভাব বিস্তার করছে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো এই বক্তব্য। লকডাউনে যেখানে বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হওয়াই নিষেধ, সেখানে তারা প্রকাশ্যে জায়গা দখল করে দোকান নির্মাণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আর পুলিশ আমাদেরকে আদালতের স্টে অর্ডারের অজুহাত দেখাচ্ছে। এতেই তো বুঝতে পারছেন আমরা কতো অসহযোগিতার মুখোমুখি হচ্ছি।’
সরকারি বিধিনিষেধের মধ্যে আখতার হোছাইন মিন্টু কাজ চালিয়ে নিলেও পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন— এই বিষয়ে প্রশ্ন করলে সাতকানিয়া থানার উপপরিদর্শক মো. মাহবুব চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এই প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘সেখানে কাজ চলছিল। আপনি কিভাবে জানেন?’ এরপর তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে কাউকে কাজ করতে দেখিনি। কিন্তু যেহেতু আমেনা বেগম অভিযোগ করেছেন তাই আমরা সেখানে যাই। গিয়ে কাউকে না পেয়ে থানায় ফিরলে বিবাদী পক্ষ আমাকে মোবাইলে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা স্থগিতের আদেশটা পাঠায়। সেটা আমি অভিযোগকারীকে অবহিত করি।’
তবে উপপরিদর্শক মাহবুব সরকারি বিধিনিষেধ অমান্য করে কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা অস্বীকার করলেও যার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তিনি তা অস্বীকার করেননি। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে আখতার হোছাইন মিন্টু বলেন, ‘নিম্ন আদালত আমেনা বেগমকে জায়গাটি ব্যবহার করার এবং আমাদের সেখানে প্রবেশ না করার যে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল তার বিরুদ্ধে আমরা জজকোর্টে আপিল করি। আমাদের আবেদনের শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে চলতি বছরের ২৬ আগস্ট। সে পর্যন্ত ওই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করা হয়েছে। তাই আমরা কাজ করছি।’
এক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত দাবি করে আখতার হোছাইন মিন্টু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই জায়গা তো আমাদের। আমরা সমাজে মেম্বারের উপস্থিতিতে আমিন এনে এটি মাপজোখ করেছি। তারাও আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু তারা তো কোনো বিচার মানেন না।’
তবে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞায় যেখানে স্পষ্টভাবে আমেনা বেগমকে ভোগ দখলের অধিকার দেওয়া হয়েছিল, জজকোর্টের দেওয়া স্থগিত আদেশে সেই ভূমি কাউকে ব্যবহার বা ভোগ দখলের বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সেক্ষেত্রে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার স্থগিত আদেশের ভিত্তিতে আখতার হোছাইন মিন্টুর কাজ চালিয়ে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন একাধিক আইনজীবী। এক্ষেত্রে আখতার হোছাইন মিন্টু আদালতের আদেশের ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
এই বিষয়ে আখতার হোছাইন মিন্টুর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এগুলো নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অবকাশ নেই। আর এই আদেশ তো ২৬ আগস্ট পর্যন্ত। উনারা সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করলে তো হয়।’
এআরটি/সিপি









