s alam cement
আক্রান্ত
৯৩২৩৪
সুস্থ
৫৮৭২১
মৃত্যু
১১০৩

বিবাহিত ও অছাত্র নেতায় ভরা চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের ৮ বছর

১ বছরের জন্য কমিটি করে এক দশকের দুয়ারে

0

মাত্র এক বছরের জন্য গঠন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি। কিন্তু সেই কমিটির বয়স এখন পুরো এক দশকের দুয়ারে। কমিটির অনেকেই বিয়েশাদি করে পেতেছেন সংসার, অনেকে ব্যস্ত চাকরি-বাকরি-ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে। কিন্তু কমিটি চলছে তো চলছেই— বছরের পর বছর ধরে। ২৯১ সদস্যবিশিষ্ট নগর ছাত্রলীগের কমিটিতে বর্তমানে প্রায় অর্ধেক নেতাই বিবাহিত। বাকিরা চাকরি ও ব্যবসার সাথে যুক্ত। হাতেগোণা দু-চারজন ছাড়া ছাত্রত্ব নেই কারোরই। অথচ ছাত্রলীগের সংবিধানে স্পষ্ট করেই লেখা আছে, বিবাহিত, অছাত্র ও চাকরিজীবী বা ব্যবসায়ী কেউ ছাত্রলীগের নেতা হতে পারবেন না।

অন্যদিকে মেয়াদোত্তীর্ণ এই কমিটির বিরুদ্ধে নগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। গঠনতন্ত্রের চরম লঙ্ঘন ছাড়াও এই কমিটির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে রয়েছে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগও। পাশাপাশি রয়েছে তৃণমূলে রাজনীতি স্তিমিত করে দেওয়ার অভিযোগ। গত কয়েক বছর ধরেই লাগাতার আন্দোলনও চলছে এই কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি দেওয়ার দাবিতে।

২০১৩ সালের ৩০ অক্টোবর কাউন্সিলের আয়োজন ছাড়াই সিলেকশনের মাধ্যমে ইমরান আহমেদ ইমুকে সভাপতি ও নুরুল আজিম রনিকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৪ জনের আংশিক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এর কিছুদিন পর ২৯১ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষিত হয়।

কমিটি ঘোষণার পর বিবাহিত ও অছাত্রদের পদে আনায় একাধিকবার বিক্ষোভ করতে দেখা যায় পদবঞ্চিত নেতাদের, এমনকি হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও। এতো কিছুর পর ইমু-রনির কমিটি প্রথমদিকে ছাত্রদের অধিকার নিয়ে কাজ করায় প্রশংসিত হতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। এ সময় চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য বাসের অর্ধেক ভাড়া, বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলোর নিয়মবর্হিভুত ফি আদায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকতে দেখা যায় মহানগর ছাত্রলীগকে। আবার কোচিং সেন্টারে চাঁদা দাবি ও মালিককে মারধরের এক ঘটনায় জড়িয়ে সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনির পদত্যাগের পর নগর ছাত্রলীগের শিক্ষাবান্ধব কার্যক্রমগুলো কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আদালতে পরে অবশ্য অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হলেও রনিকে আর ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ফিরতে দেখা যায়নি।

এ সময় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় জাকারিয়া দস্তগীরকে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষাবান্ধব কার্যক্রমের বদলে ছাত্রলীগ নেতাদের বেশিরভাগই একপর্যায়ে নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ ব্যস্ত হয়ে পড়েন সরকারি অফিসগুলোতে টেন্ডারবাজির ভাগাভাগি নিয়ে, কেউবা ব্যস্ত অফিসের চাকরি নিয়ে। ফলে সেভাবে কোনো ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি আর দেখা যায়নি। সর্বশেষ সিআরবি রক্ষা আন্দোলন ও করোনা ইস্যুতেও তেমন কোনো কর্মসূচি এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি নগর ছাত্রলীগ। তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ অক্সিজেন সেবা, ফ্রি সবজি বাজার থেকে শুরু করে ফ্রি সিএনজি সার্ভিসের মতো উদ্যোগে শামিল হন। কিন্তু নগর ছাত্রলীগ বরাবরের মতোই নতুন বৌয়ের মত ঘরে বসে থেকেছে। নগর ছাত্রলীগের একাধিক সাবেক ছাত্রনেতা বলেন, করোনায় যখন মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ এসেছে, তখন নগর ছাত্রলীগ নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে ঘরবন্দি হয়ে থাকাতেই সুখ খুঁজে পেয়েছে।

সাবেক এই ছাত্রনেতারা মনে করেন, সিআরবি ও করোনা ইস্যুতে নগর ছাত্রলীগ চাইলে অনেক কার্যক্রম হাতে নিতে পারতো। করোনায় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দু-চারটা আয়োজন করতে পারতো। এমন সুযোগ হাতছাড়া করায় নগর ছাত্রলীগের নেতাদের ভুগতে হবে বলেও মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের সাবেক ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ।

Din Mohammed Convention Hall

নগর ছাত্রলীগের পদধারী অনেক নেতাকে এখন বউ-বাচ্চা নিয়ে কাটাতে দেখা যায়। করোনার আগে অনেক নেতার ফেসবুকে শোভা পেতে দেখা গেছে, বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার মধুর সব মুহূর্ত। প্রকাশ্যে এই ছাত্রনেতাদের বিয়ে করতে দেখা না গেলেও কর্মীদের পক্ষ থেকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেখে হাস্যরসেরও সৃষ্টি হচ্ছে রাজনীতি অঙ্গনে। তবে কেউ কেউ আবার এতো রহস্য না রেখে সরাসরি বউ-বাচ্চাসহ ফেসবুকে হাজির হয়ে চমকে দিচ্ছেন সবাইকে।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইমু-দস্তগীরের বিপক্ষে অনাস্থা প্রকাশ করেন বর্তমান কমিটির ৪৬ জন নেতা। এছাড়া নগর ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটিকে অকার্যকর ও মেয়াদউত্তীর্ণ অভিহিত করে নতুন কমিটির দাবিতে মিছিল-বিক্ষোভও হয়েছে একাধিকবার। মহানগর কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-সম্পাদক নাছির উদ্দীন কুতুবী ওই সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়েছিলেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের মেয়াদোত্তীর্ণ ২৯১ সদস্যের কমিটিতে ৫৬ জন বিবাহিত ও ১৬২ জনই অছাত্র।’

তবে অনাস্থা দেওয়া ওই ৪৬ নেতার বিষয়ে সভাপতি ইমু বলেছিলেন, ৪৬ জনের মধ্যে ২০-২২ জনই বিবাহিত। তাদের অনেকের বিয়েতে ইমু নিজেই উপস্থিত ছিলেন বলেও দাবি করেন। আর বাকিরা অছাত্র বলে তাদের ‘অনাস্থা’কে প্রত্যাখ্যান করেন ইমু।

তবে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি মেয়াদউত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি মাথায় আছে এবং যে কোনো সময় নতুন কমিটি আসতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তারা বলছেন, করোনার কারণে সংগঠনকে ভিন্নভাবে পরিচালিত করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে মেয়াদউত্তীর্ণ ঠাকুরগাঁও, ময়মনসিংহ ও কক্সবাজার কমিটি ভেঙে নতুন কমিটিও দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের নগর ছাত্রলীগও সেই তালিকায় রয়েছে জানিয়ে তারা বলেন, খুব শীঘ্রই চট্টগ্রাম নগরে নতুন নেতৃত্ব আসবে।

নগর ছাত্রলীগের এমন দুরাবস্থা কেন— এমন প্রশ্নে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তিনি বলেন, ‘আমি এখন যুবলীগের রাজনীতি করি। একসময় ছাত্ররাজনীতি করতাম। ছাত্রদের পাশে থাকতাম, তাদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কাজ করতাম। যেহেতু বর্তমানে আমি ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত নই, তাই এসব বিষয়ে কোনো কথাও বলতে চাই না।’

এদিকে ইমু-দস্তগীর কমিটির ঘোষিত ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের কমিটিগুলো নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ। তৃণমূল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেছেন— খুনের দায়ে অভিযুক্ত, কিশোর গ্যাং লিডার, মাদকসেবী থেকে শুরু করে এমনকি ফার্নিচার মিস্ত্রিকেও ছাত্রলীগের নেতা বানানো হয়েছে সেই সব কমিটিতে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়া যুবলীগ নেতাকেও থানা ছাত্রলীগের সদস্য করার মত অদ্ভূত ঘটনাও ঘটেছে।

অন্যদিকে কলেজ কমিটিগুলো নিয়েও নগর ছাত্রলীগে নানা অসন্তোষ। শুধুমাত্র নিজেদের ‘মাই ম্যান’কে নেতা বানানোর অভিলাষ থেকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে ভেড়ানো হয়েছে খুনের মামলার আসামি, ইয়াবা বিক্রেতা ও অছাত্রদের— এমন অভিযোগও শোনা গেছে বহুবার। উদাহরণ হিসেবে তৃণমূলের কর্মীরা অভিযোগ করেন, বঙ্গবন্ধুর ব্যানার ছিঁড়ে মহসিন কলেজের আহ্বায়ক হয়েছেন কাজী নাঈম— যিনি মোবাইল চুরি করতে গিয়ে গণপিটুনিও খেয়েছেন। সাংগঠনিক কোনো কর্মকাণ্ডে না থেকেও শুধুমাত্র বড় নেতার অনুরোধে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদকের পদ পেয়েছেন একজন। অভিযোগ ওঠে, চট্টগ্রাম কলেজের উপ-সম্পাদকীয় পদবির নেতা রিফাত ছিলেন নিজ গ্রামের ছাত্রদল নেতা। নেতা হওয়ার মাসখানেক পর হাজারখানেক ইয়াবা নিয়ে পুলিশের হাতে আটক হন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের এই নেতা।

চলতি আগস্টের পরে চট্টগ্রাম মহানগরে আরও বেশ কয়েকটি থানা ও ওয়ার্ড কমিটি ঘোষণার কথা শোনা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় কেউ বর্তমান কমিটির বেহাল অবস্থার কথা বলে ‘নিজেদের পায়ে কুড়াল’ মারতে রাজি নন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতা বলেন, ‘সামনে ওরা কমিটি দেবে। এখন আমি যদি কিছু বলি, তাহলে ওরা আমার ছেলেদের পোস্ট দেবে না। তাই ওদের ব্যাপারে কিছু বলে আমি আমার কর্মীদের বিপদে ফেলতে চাই না।’

নগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুধু আমাদের কমিটি কেন হবে? নগর আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ— কারোরই মেয়াদ নেই। আমরাও চাই নগরে নতুন কমিটি হোক, নতুন নেতৃত্ব আসুক। ইতিমধ্যে আমরা নতুন কমিটির বিষয়ে একাধিকবার কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে জানিয়েছি। আর নগরে ওয়ার্ড ও থানা কমিটি হওয়ায় নগর ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড বেড়েছে এবং সম্মেলনের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।’

ওয়ার্ড, থানা ও কলেজ কমিটিগুলো নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অসন্তোষ নিয়ে জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করি সঠিক নেতাদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে। তারপরও কিছু খারাপ ছেলে পদ পাওয়ার পর আমাদের সব কষ্ট ব্যর্থ হয়ে যায়।’ যেসব ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিষয়ে তথ্যপ্রমাণসহ নগর ছাত্রলীগকে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাই তাহলে তাদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করব।’

ইমু-দস্তগীরের কমিটির বিরুদ্ধাচারণ করায় বহিষ্কৃত হতে হয় নগর ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতি ও এক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদককে। তাদের একজন নগর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিথুন মল্লিক চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের অষ্টম বর্ষপূর্তি বিষয়ে বলেন, ‘কতটুকু পথ হাঁটলে একজন পথিককে পথিক বলা যায়, আর কত বছর পদে থাকলে তাদের সফল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বলা যায়? এই আটটা বছর যে তারা পদ আগলে ধরেছে, এই আট বছরে কত রানিং ছাত্র তাদের পাঠ চুকিয়ে চলে গেছে। এতগুলো ছাত্রলীগ কর্মীর দীর্ঘশ্বাসের ভার কে বহন করবে?’

তিনি বলেন, ‘ইমু-দস্তগীর নিজেদের ইচ্ছামত কমিটি দিচ্ছে। কারো সাথে আলাপ করে না। মাদক ব্যবসায়ী, খুনিদের ছাত্রনেতা বানাচ্ছে। আর আমাদের সত্যিকারের কর্মীদের সদস্যপদটুকুও দিচ্ছে না। তাহলে এ অবস্থায় কী করতে পারি আমরা? কেউ কি কখনও জানতে চেয়েছিল?’

সিপি

ManaratResponsive

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm