মধ্যবিত্তের ফ্ল্যাট নিয়ে চট্টগ্রাম কক্সবাজারে গৃহায়নের লুটপাট, অভিযুক্ত একজনের ‘সেকেন্ড হোম’ লন্ডন

নামমাত্র মাটি ভরাট করেও দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ

0

চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সাধারণ মানুষের জন্য তৈরি করা ফ্ল্যাট ঘুষের বিনিময়ে পছন্দের লোকজনের মাঝে বরাদ্দ দিয়ে লুটপাট করেছেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের তিন কর্মকর্তা। এসব ফ্ল্যাট বরাদ্দে এমনকি নিয়মনীতিও মানেননি তারা। এদের একজন ঘুষের টাকায় লন্ডনকে বানিয়েছেন ‘সেকেন্ড হোম’। অন্যদিকে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য এক আবাসন প্রকল্পে সামান্য মাটি ভরাট দেখিয়ে ২ কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়া হয়েছে এই কর্মকর্তাদের যোগসাজশে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে টাকা লুটপাটের এমন সব ঘটনা বেরিয়ে এলেও তদন্ত প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আটকা পড়েছে গত ১৪ মাস ধরে। এর ফলে দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা।

হালিশহরে ফ্ল্যাট নিয়ে অভিনব জালিয়াতি

জানা গেছে, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমতি ছাড়াই চট্টগ্রামের হালিশহরে নির্মাণ করা ২৬০টি ফ্ল্যাট পছন্দের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, হালিশহর হাউজিং এস্টেটের জি-ব্লকে ১০৮টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের ইমারত নম্বর ২ এর ফ্ল্যাট নম্বর-২সি/১ আয়তন ১২২৪ বর্গফুটের বরাদ্দ দেওয়া হয় জালাল আহমেদ সওদাগরের পুত্র সগীর আহমেদ রানাকে। টাকা না দিয়েও জাল-জালিয়াতি ও ভুয়া তথ্য সৃজন করে অবৈধপথে রানাকে সেই বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১১ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারি যে কোনো বাসায় আবাসিক খাতে বেসরকারি কোনো ব্যক্তি ভাড়া থাকলে ৮ টাকা স্কয়ার ফিট ধরে ভাড়া হিসাব করা করার নিয়ম রয়েছে। সেই হিসেবে সগীর আহমেদ রানা ৬ বছর ১ মাস ১০ দিন তথা ৭৩ মাস হিসেবে ৭ লাখ ১৪ হাজার ৮১৬ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, হালিশহরে ফ্ল্যাট উন্নয়ন প্রকল্পে সগীর আহমেদ রানাকে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে কোনো ধরনের জামানত এবং কিস্তি গ্রহণ ছাড়াই দেওয়া হয়েছে ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্র। ফ্ল্যাটের চাবিও বুঝিয়ে দেওয়া হয় তাকে। সেখানে দুই বছরের বেশি সময়ে ওই ফ্ল্যাটটি দখল করে কোনো ধরনের কিস্তি দেওয়া ছাড়াই অবৈধভাবে ভোগদখলে রয়েছেন রানা। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া রানার ফ্ল্যাটের আবেদনপত্রে ফ্ল্যাট নোট অনুমোদন প্রদানসহ বরাদ্দপত্রে স্বাক্ষর করেন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামসুল আলম।

এছাড়া হালিশহর হাউজিং এস্টেটের হালিশহর হাউজিং এস্টেটের জি-ব্লকে (তৃতীয় পর্যায়) ফিরোজ আহমদ ও নিলুফার বেগমকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ প্রদানের বিপরীতে জাল রেকর্ড-তথ্য সৃজন করে বরাদ্দপত্র দিয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করায় তাদের বিরুদ্ধে একটি নিয়মিত মামলা দায়েরের জন্য সুপারিশ করে আংশিক অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেছেন দুদকের সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা মো. শরীফ উদ্দিন।

ফ্ল্যাট নিয়ে হরিলুট হয়েছে কক্সবাজারের কলাতলীতে।
ফ্ল্যাট নিয়ে হরিলুট হয়েছে কক্সবাজারের কলাতলীতে।

ফ্ল্যাট নিয়ে হরিলুট কক্সবাজারের কলাতলীতে

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার কলাতলী এলাকায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম ‘কক্সবাজার ফ্ল্যাট উন্নয়ন প্রকল্পের’ নামে তৈরি করে ৫৬টি ফ্ল্যাট। প্রতিটি ফ্ল্যাটের দাম নির্ধারণ করা হয় ৩৮ থেকে ৪০ লাখ টাকা। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি ছাড়াই গত তিন বছরে ফ্ল্যাটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয় কিস্তিতে। ২ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নিয়ে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের পছন্দের লোকজনকে দেওয়া হয়েছে সেই বরাদ্দ। নীতিমালা অনুসারে কিস্তিতে ফ্ল্যাট নিয়ে মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে মূল টাকা সঙ্গে সুদসহ পরিশোধ করার নিয়ম থাকলেও ক্রেতাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়নি সুদের টাকা। এক্ষেত্রে কর্মকর্তারা নিজেরা লাভবান হওয়ার আশায় পরস্পর যোগসাজশে মোট ফ্ল্যাটের বরাদ্দপত্রগুলোতে সুদের কথাটি উল্লেখ না করে কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব থেকে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করে। আর এই জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তেও।

নামমাত্র মাটি ভরাট করে দুই কোটি টাকা আত্মসাৎ

চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার কিসমত জাফরাবাদ মৌজায় সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন নামে একটি প্রকল্প ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর অনুমোদন করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। পরে প্রকল্পটি স্থবির হয়ে গেলে ২০১৯ সালের ২০ মার্চ এক চিঠির মাধ্যমে তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. রাশিদুল ইসলাম তা বাতিল করেন। গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দাপ্তরিক নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, এ প্রকল্পের বিপরীতে মোট বিল দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৬৬ হাজার ১০৬ টাকা। সেখানে সংশ্লিষ্টরা প্রকল্পটিতে ৭৮ লাখ ৯৩ হাজার ঘনমিটার মাটি ভরাটের কথা উল্লেখ করে বিল পরিশোধ করেছেন। কিন্তু বাস্তবে ৩২ হাজার ৮৬৪ দশমিক ৬৭ ঘনমিটার মাটি ভরাট করা হয়েছে। ২২৯ দশমিক ২৫ টাকা প্রতি ঘনমিটারে এর মোট বিলের পরিমাণ হয় মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। এখানে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার মাটি ভরাট না করেই বিল দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলী কাওসার মোর্শেদ, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. অলিউল ইসলাম, উপসহকারী প্রকৌশলী আশ্রাফুজ্জামান ও বিভাগীয় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজটি করেছে মেসার্স হক কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড মেসার্স ইউটি মং (জেভি)।

২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি সরেজমিনে পরিদর্শন করে এই অনিয়মের সত্যতা পান গৃহায়ন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বিভাগীয় তদন্ত কর্মকর্তা ও সচিব। নামমাত্র মাটি ভরাটের কাজ দেখিয়ে বিপুল টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাও। প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাকে নির্বাহী প্রকৌশলী কাউসার মোর্শেদ ছাড়াও জড়িত রয়েছেন সংশ্লিষ্ট উপসহকারী প্রকৌশলী পলাশও।

দুর্নীতিতে অভিযুক্ত তিনজন

২০২০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর দুদকের এই অনুসন্ধানে তিনজনকে অভিযুক্ত করে প্রধান কার্যালয় কমিশন বরাবরে আংশিক প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন দুদক তদন্ত কর্মকর্তা। প্রায় ১৪ মাস আগে দুদক কমিশন বরাবরে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানোর পরও এখনও পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনটি।

জানা গেছে, অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামসুল আলম— তিনি বর্তমানে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ দিনাজপুর ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি সিলেট জেলার সিলেট সদর থানার ২৪ তালতোলায়। অভিযুক্ত অপর একজন হলেন জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাবেক নির্বাহী প্রকোশলী কাউসার মোর্শেদ। তিনি বর্তমানে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ রাজশাহী ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৗশলী হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার বাড়ি রংপুর জেলার কোতোয়ালী থানার রংপুর সদর এলাকায়। দুদকের তদন্তের তৃতীয় যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি হলেন চট্টগ্রামের হালিশহর হাউজিং এস্টেট ব্লক-জি এর ফ্ল্যাট নম্বর সি/১ এর জালাল আহমেদ সওদাগরের পুত্র সগীর আহমেদ রানা।

লন্ডনে ‘সেকেন্ড হোম’

দুদক সুত্রে জানায়, প্রায় দেড় বছর আগে ফ্ল্যাট বাণিজ্যে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের প্রধান দুই কর্মকর্তা প্রকৌশলী শামসুল আলম ও কাউসার মোর্শেদকে তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম থেকে বদলি করা হয়। ওই সময় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামসুল আলমের পদাবনতি ঘটিয়ে দিনাজপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে বদলি করা হয় তাকে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রামের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শামসুল আলম ও তার স্ত্রী লন্ডনে সপরিবারে বসবাস করছেন। অবৈধ উপায়ে আয় করা টাকা বিদেশে পাচার করে লন্ডনকে ‘সেকেন্ড হোম’ করেছেন শামসুল আলম। তার পাসপোর্টের কপি নিলে এমনটাই প্রমাণ মেলবে বলে দাবি করছেন দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা। একই সঙ্গে তার অন্যতম সহযোগী সাবেক নির্বাহী কাউসার মোর্শেদের অপকর্মে বেশ কিছু তথ্য দিয়েছে চট্টগ্রামের বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী গিয়াসউদ্দিন চৌধুরীও।

১৪ মাস ধরে তদন্ত প্রতিবেদন দুদকের হিমাগারে

জানা যায়, ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের সরকারি ফ্ল্যাট বরাদ্দে অনিয়মের তথ্য তুলে ধরে দুর্নীতি দমন কমিশন বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেন হীরা নামের এক ভুক্তভোগী। ওই বছর ১ অক্টোবর এসব অনিয়মের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর উপসহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।

দুদক কর্মকর্তা জানান, প্রায় ১৪ মাস আগে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সরেজমিনে তদন্ত করে অনিয়মের আংশিক প্রতিবেদন দুদকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। মামলা দায়ের করার সিদ্ধান্ত দেবেন কমিশন। কমিশনের সিদ্ধান্তের পর মামলা হবে। ফ্ল্যাট বাণিজ্যের সঙ্গে আরও বেশ কিছু কর্মকর্তা জড়িত থাকারও প্রমাণ মিলেছে বলে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, মামলা দায়ের পরপরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm