মেঘনা পেট্রোলিয়ামে ৩ কর্মকর্তার ‘কৌশলের মারপ্যাচ’, কাজ পায় এক ঠিকাদারই
ঠিকাদারদের কাছে গোপন রাখা হয় দরপত্রের প্রকৃত মূল্য
পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ পাইয়ে দিতে শিডিউলের প্রকৃত মূল্য গোপন করার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের বিরুদ্ধে। তাদের এমন ফাঁদে পড়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন অন্যান্য ঠিকাদাররা। আর মোটা অংকের টাকা নিয়ে এমন কাজ করছেন প্রতিষ্ঠানটির তিন অসাধু কর্মকর্তা। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বরাবরে চিঠি দিয়েছেন এক ভুক্তভোগী ঠিকাদার।
জানা গেছে, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি (ওটিএম) মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করার পর নিয়ম অনুযায়ী দরপত্রে যেসব প্রতিষ্ঠান অংশ গ্রহণ করবে, ওই প্রতিষ্ঠানগুলো শিডিউলের মোট মূল্যের অংকের ১০ ভাগ অর্থ কম বা বেশি দেখিয়ে দরপত্র দাখিল করে থাকেন। কিন্তু শিডিউল মোট মূল্যের অংকের ১০ ভাগ অর্থ কম বা বেশি দেখিয়ে দরপত্র দাখিল করেও কাজ পাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। মূলত পছন্দের প্রতিষ্ঠান দরপত্রের কাজটি পাইয়ে দিতে প্রকৃত শিডিউল মূল্য গোপন করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের দরপত্র কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল ম্যানেজার (এইচআর) ইনাম ইলাহী চৌধুরী, জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামের ‘কৌশলের মারপ্যাচে’ একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বারবার কাজ পেলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর বিনিময়ে ওই কর্মকর্তাদের পকেটে ঢুকছে মোটা অংকের টাকা।
এদিকে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে টেন্ডারের কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ এনে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড চট্টগ্রামের এমডি মো. টিপু সুলতান বরাবরে চিঠি দিয়েছেন ফারদিন বিল্ডার্সের স্বত্বাধিকারী মেহেদী হাসান সুমন। এছাড়া জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন্স) মো. মফিজুর রহমান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট জেনারেল ম্যানেজার (পার্চেজ) মোহাম্মদ শরিফুল ইসলামকে ওই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়।
চিঠিতে বলা হয়, ঝালকাঠী ডিপোর পার নম্বর ০৪২ (২০২৩-২০২৪), টেন্ডার আইডি নম্বর ৯০০২৮৯। মেঘনা পেট্রোলিয়ামের লিমিটেড বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেওয়া দরপত্রে ঝালকাঠী ডিপোতে আরসিসি ফুটপাত, ড্রেন, ট্যাংকের চারপাশে ওয়ার্কওয়ে ও বৈদ্যুতিক মিটার রুম হস্তান্তরসহ অন্যান্য কাজের দরপত্রে অংশ নেয় ফারদিন বিল্ডার্স। কর্তৃপক্ষের ওটিএম’র নিয়ম অনুযায়ী মোট মূল্যের মধ্যে দরপত্র দাখিল করা হয়। দরপত্রের মোট মূল্য দেখানো হয় ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। সেখানে ওই মোট মূল্যের অংকের হিসাব থেকে ১০ পারসেন্ট নিম্নে দরপত্র দাখিল করা হয়। কিন্তু দরপত্র খোলার পর দেখতে পায় কর্তৃপক্ষের অফিশিয়াল দরপত্রের মোট মূল্য ছিল ৫২ লাখ ৭৭ হাজার ৪৯ টাকা। সেখানে দরপত্রের প্রকৃত হিসাব আগে থেকে জেনে যাওয়ায় মোট মূল্য হিসাব থেকে ১০ পারসেন্ট কম দিয়ে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে কাজটি পেয়েছে ‘টিএস এন্টারপ্রাইজ’।
চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা বারবার দরপত্রে অংশ করে কাজ পাচ্ছি না। যেসব প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে কতিপয় অসাধু কর্মকর্তারা যোগসাজশ করে তাদেরকে দরপত্রের অফিশিয়াল প্রকৃত মোট মূল্য বলে দেওয়া হয়। এসব অসাধু কর্মকর্তাদের দুটি পছন্দের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হল—টিএস এন্টারপ্রাইজ ও সুকন্যা এন্টারপ্রাইজ। এই দুই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী এক ব্যক্তি। প্রতিষ্ঠান দুটি গত ৫ বছর ধরে অনেক কাজ করেছে। এসব তথ্যের সত্যতা হিসেবে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের চট্টগ্রামের এজিএম পার্চেজ সেকশনের ফাইল দেখলে প্রমাণ মিলবে। এতে আমার হাজার হাজার টাকা খরচ করে তাদের কৌশলের কারণে দরপত্র অংশ গ্রহণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
ওটিএম না করে ওএসটিইটিএম পদ্ধতিতে নতুনভাবে ওই দরপত্রটি আহ্বান করার অনুরোধ করা হয় ওই চিঠিতে।
এদিকে চলতি বছরের এপ্রিলে আবারও পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে একইদিনে পৃথকভাবে দুটি দরপত্র দেয় মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। ওই দরপত্রের শেষ সময় দেয় চলতি বছরের ২১ এপ্রিল। ওই দরপত্রে ওএসটিইটিএম পদ্ধতিতে দুটি কাজের আহ্বান করা হয়। একটি বরিশাল (দরপত্র নম্বর ৯৫৮৫৭৯) অপরটি ঢাকায় (দরপত্র নম্বর ৯৫৮৫৭১)। এই দুটি দরপত্রে খোলার কথা ছিল চলতি বছরের ২২ এপ্রিলে। দুটি দরপত্র হল কনস্ট্রাকশন কাজ। একইদিনে পৃথকভাবে আরও একটি কনস্ট্রাকশন কাজ চট্টগ্রামে ওটিএম করে দরপত্রে আহ্বান করা হয়। যার দরপত্র নম্বর ৯৬৫৩১৮, পিইউআর-১২৮।
অভিযোগ রয়েছে, পছন্দের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ওই কাজটি পাইয়ে দিতে একইদিনে তিনটি কনস্ট্রাকশন কাজের দরপত্র আহ্বান করে চট্টগ্রামের মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই তিনটি কাজের মধ্যে দুটি কাজ দিয়েছে ওএসটিইটিএম পদ্ধতিতে এবং পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে একটি ওটিএম পদ্ধতিতে দিয়েছে। মূলত তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে দরপত্রের কাজটি দিতে ওটিএম পদ্ধতিতে আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে তাদের কৌশল।
অভিযোগের বিষয়ে ডিজিএম (অপারেশন্স) মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘এটি আমার বিভাগের কাজ না। সংশ্লিষ্ট বিভাগ এই বিষয়ে ভাল বলতে পারবে।’
জানতে চাইলে টেন্ডার কমিটির চেয়ারম্যান মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের জিএম (এইচআর) মো. ইনাম ইলাহী চৌধুরীর মুঠোফোনে বলেন, ‘এটা তো এখন শুনেছি। তারপরও বিষয়টি দেখছি।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের এমডি মো. টিপু সুলতানকে মুঠোফোনে কল দেয়া হলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘বিষয়টি এই মুহূর্তে আমার জানা নেই। বিষয়টি আমি খোঁজ নিচ্ছি।’
ডিজে