১ লাখ ৯২ হাজার টাকার বিল পেতে ৮০ হাজার ঘুষ, কম দেওয়ায় ক্ষিপ্ত সমাজসেবা কর্মচারী

কক্সবাজারের চকরিয়ার উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আমজাদ হোসেন। জরিপ, অডিট থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিলের অনুমোদন—যে কাজই হোক না কেন, ঘুষ ছাড়া তিনি করেন না। তার এই ঘুষের টাকা লেনদেনের অঘোষিত ক্যাশিয়ার হলেন একই অফিসের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মমতাজ বেগম। আমজাদের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা তিনিই বুঝে নেন। সম্প্রতি এক ব্যক্তির কাছ থেকে মমতাজ বেগমের ঘুষের টাকা গুণে নেওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।

৬ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কার্যালয়ে মমতাজ বেগমের কক্ষে যান। এ সময় ওই ব্যক্তি পকেট থেকে এক হাজার টাকার বেশ কিছু নোটের একটি বান্ডিল মমতাজ বেগমকে দেন। মমতাজ বেগম জিজ্ঞেস করেন, এখানে কত দিয়েছেন? তখন ওই ব্যক্তি গুণে নিতে বললে, মমতাজ মুখে বলতে বলেন। এরপর মমতাজ টাকার বান্ডিল হাতে নেন এবং টাকাগুলো গুনতে থাকেন।

তখন ওই ব্যক্তি মমতাজ বেগমের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি টাকা তুলতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে টাকা এনেছি। প্রথম কিস্তির বরাদ্দ ১ লাখ ৯২ হাজার সই না থাকায় তুলে পারিনি।’ তখন মমতাজ বেগম ওই ব্যক্তিকে বলেন, ‘আপনি ঠকে যাবেন। আপনার প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।’ মমতাজ বেগমকে ওই ব্যক্তি অনুরোধ করে বলেন, ‘আমি বেঁচে থাকলে পাবেন।’
‘এ টাকা নিলে আমাকে বকা দিবে’—জানিয়ে মমতাজ বেগম ফোন কল দেন সমাজসেবা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেনকে। ফোনে তিনি বলেন, ‘স্যার (আমজাদ হোসেন) রফিক মেম্বার ৮০ হাজার দেওয়ার কথা ছিল, ৪০ হাজার দিয়েছে। স্যার, এক মাস পর আবার বিল আছে, তখন কেটে রাখতে হবে।’

ভিডিওতে ঘুষ দেওয়া ওই ব্যক্তির নাম রফিকুল ইসলাম। তিনি হারবাং মধ্যম পহরচাঁদা এতিমখানার সভাপতি ও সাবেক ইউপি সদস্য। এ ঘটনায় তিনি সমাজকল্যাণমন্ত্রী, সচিব, দুদকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রফিকুল ইসলাম জানান, ভিক্ষুকদের সেলাই মেশিন দিবে বলে আমার কাছে ৫ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল চকরিয়া সমাজসেবা অফিস। এ চাঁদা দিতে না পারায় ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর এতিমখানা পরিদর্শন করে। পরদিনই আমি অফিসে যাই, কেন এসেছি জানতে চেয়ে বকাবকি শুরু করেন। ‘জরিপ ও বিলের সময় দেখিয়ে ছাড়ব’ বলে হুমকি দেন। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের বিল দাখিল করলে আমাকে বলেন, পরিদর্শন কর্মকর্তা বিল না দিতে বলেছে।

তিনি আরও জানান, সমাজসেবা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন ও অফিস সহকারী মমতাজ বেগমের সঙ্গে তিন দফা বৈঠক করি। ২০২৩-২৪ সালের প্রথম কিস্তি ১ লাখ ৯২ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা তাদের ঘুষ দিতে হবে বলে জানায় তারা। অন্যথায় এতিমখানার টাকা ফেরত পাঠিয়ে দেবে। তাদের কথায় রাজি হয়ে চেক গ্রহণ করি। চলতি মাসের ৮ তারিখ সমাজসেবা অফিসে গিয়ে দুপুর ১২টার দিকে অফিস সহকারী মমতাজ বেগমকে ৪০ হাজার দিই। এ টাকা গুনে নেওয়ার সময় মমতাজ বেগম জানতে চান, বাকি ৪০ হাজার কোথায়? এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে আমজাদ হোসেনকে ফোন করে বলে, রফিক মেম্বার আমার সঙ্গে বাটপারি করেছে, দ্বিতীয় কিস্তির সময় ৪০ হাজার টাকা রেখে দেব।

এদিকে অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলায় সমাজসেবার তালিকাভুক্ত ২৮টি এতিমখানা রয়েছে। সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন এতিমখানা অডিট করতে গেলে ১০ হাজার টাকা করে নেন। এ টাকা না দিলে অডিট না করেই চলে আসেন। এতিমখানা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা ও উপবৃত্তির উত্তোলনের সময়ও তাকে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ লেনদেন ছাড়াও এ কর্মকর্তার গ্রাহকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য নিতে চকরিয়া উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মমতাজ বেগমের মুঠোফোন নম্বরে বেশ কয়েকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি।

অফিসকক্ষে ঘুষ লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আমজাদ হোসেনের বলেন, ‘অফিসে আসেন, তখন বিস্তারিত জানাবো।’

জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক হাসান মাসুদ বলেন, ‘এই সংক্রান্ত একটি অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!