চট্টগ্রামে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীরই উল্টো বানোয়াট মামলা, আসামি ২৭ সাংবাদিক

সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নিন্দা ও প্রতিবাদ

নিজের ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট দিয়ে সাংবাদিকদের ওপর পরিকল্পিত হামলা চালানোর দায়ে আটক হওয়া ব্যক্তি ১২ দিন পর আবার উল্টো মামলা ঠুকে দিয়েছেন চট্টগ্রামের ২৭ জন শীর্ষ সারির সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সাংবাদিকসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৭০-৮০ জন আসামি দেখানো হয়েছে ওই মামলায়।

মঙ্গলবার (১৩ মে) চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো.আবু বকর সিদ্দিকের আদালতে এই মামলা দায়ের করা হয়। আদালত মামলাটি তদন্ত করার জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) চট্টগ্রাম মেট্রোকে নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানান আদালতের বেঞ্চ সহকারী এএসএম নূরে খোদা।

মামলার আরজিতে ওই যুবকের নাম রেজাউল ইসলাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাদি এজাহারে নিজেকে ‘অ্যাডভোকেট’ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। এজাহারে রেজাউল নামের ওই যুবক উল্লেখ করেছেন, ছাত্রজীবনে তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাথে যুক্ত ছিলেন এবং বর্তমানে তিনি জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রামের সদস্য।

এদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এমন হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ায় চট্টগ্রামের শীর্ষ আইনজীবীরা উষ্মা প্রকাশ করেছেন। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নাম ব্যবহার করায় কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতাদের কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে জানান, বিষয়টি তারা নজরে রাখছেন এবং বিএনপি বা তার অঙ্গসংগঠনের নাম ব্যবহার করে এ ধরনের অপকর্ম তারা সহ্য করবেন না।

সাংবাদিকদের ওপর হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া রেজাউল মামলার এজাহারে উল্টো দাবি করেছেন, সাংবাদিকরা তাকে মারধর করে, মোবাইল ও টাকা ছিনিয়ে নেয়, ককটেল বিস্ফোরণ করে আহত করে এবং মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। অথচ সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা ঘটনার পুরো বিপরীত বিবরণ দিয়েছেন।

ঘটনার সঙ্গে অভিযোগের মিল নেই

এদিকে চট্টগ্রামে কর্মরত সাংবাদিকদেরকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোর ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) নেতৃবৃন্দ।

এক বিবৃতিতে সিইউজের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ বলেন, ওই যুবক গত ৩০ এপ্রিল নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সম্মিলনী অনুষ্ঠান প্রতিহত করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন। মে দিবস উপলক্ষে গত ১ মে আনোয়ারা পারকি সৈকতে ওই সম্মিলনী অনুষ্ঠিত হয়। ঘোষণার পরদিন (১ মে) সকালে চট্টগ্রাম নগরের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ গেটের সামনে সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হয়। হামলায় তিন সাংবাদিক আহত হন। তারা হলেন— ডেইলি লাইফ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক প্রদীপ কুমার শীল, যায়যায়দিন পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ খোরশেদুল আলম শামীম ও দৈনিক পূর্বদেশের সাব-এডিটর শফিকুল ইসলাম খান।

এ ঘটনায় ঘটনাস্থলে থাকা লোকজন উল্লিখিত রেজাউল ইসলামের সাথে শহীদ ওরফে কোরবান আলীকেও (২৬) খুলশী থানা পুলিশের হাতে তুলে দেন। আদালতে রেজাউল ইসলাম নামের ওই যুবকের দায়ের করা মামলাকে বানোয়াট বলে উল্লেখ করে নেতৃবৃন্দ বলেন, প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতে এই মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সদস্য প্রদীপ শীলসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ৭০ থেকে ৮০ জনকে আসামি করা হয়েছে। নাম উল্লেখ করা আসামিদের মধ্যে ২৭ জন সাংবাদিক রয়েছেন। আরজিতে উল্লিখিত ঘটনার সাথে ওইদিনের আসল ঘটনার কোন মিল নেই উল্লেখ করে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা হলো। আবার উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই মামলাও দেওয়া হলো। এটা মানবাধিকার ও আইনের চরম লঙ্ঘন।

যা ঘটেছিল সাংবাদিকদের সঙ্গে

জানা গেছে, মে দিবস উপলক্ষে চট্টগ্রামে কর্মরত সাংবাদিকরা আনোয়ারার পারকি বিচে পিকনিকের আয়োজন করে। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের সামনে সাংবাদিকদের পরিবহনের জন্য বেশ কয়েকটি বাস এসে অবস্থান করছিল। এ সময় রেজাউল ইসলামের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত বাসচালকদের কাছ থেকে চাবি কেড়ে নেয়। এর প্রতিবাদ করলে তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। ফটোসাংবাদিক প্রদীপ শীলকে এ সময় তারা একটি সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে জোর করে তুলে অপহরণের চেষ্টা করে। এই সময় স্থানীয় লোকজন এসে দুর্বৃত্তদের কবল থেকে সাংবাদিকদের উদ্ধার করে এবং হামলাকারী দুজনকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। ঘটনার আগের দিন রেজাউলসহ অন্যরা নিজের ফেসবুক আইডি থেকে উস্কানিমূলক পোস্ট দেন। তারা সেখানে সকাল থেকেই পরিকল্পিতভাবে অবস্থান করছিল।

দুর্বৃত্তদের হামলায় তিন সাংবাদিক আহত হন। তারা হলেন— ডেইলি লাইফ পত্রিকার ফটো সাংবাদিক প্রদীপ কুমার শীল, দৈনিক যায়যায়দিনের চট্টগ্রাম ব্যুরো চিফ খোরশেদুল আলম শামীম এবং দৈনিক পূর্বদেশের সহ-সম্পাদক শফিকুল ইসলাম খান।

এ ঘটনায় আশেপাশের লোকজন এগিয়ে এসে হামলাকারীদের দুজনকে হাতেনাতে ধরে থানায় ফোন করে পুলিশের সাহায্য চায়। পরে খুলশী থানা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে এলে হামলাকারী দুজনকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। আটক ওই দুজনের নাম রেজাউল ইসলাম (৩২) ও শহীদ ওরফে কোরবান আলী (২৬)। হামলাকারী অন্যরা সুযোগ বুঝে বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়।

খুলশী থানার ওসি আফতাব আহমেদ ঘটনার পর সাংবাদিকদের বলেন, জমিয়তুল ফালাহ মসজিদের সামনে সংঘটিত ঘটনায় দুজনকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। যেহেতু ঘটনার উৎপত্তিস্থল ও হামলার ঘটনাস্থল দুটি ভিন্ন, তাই তদন্ত করে এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা ও প্রতিবাদ

এদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের ঘটনায় প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি সালাহ উদ্দিন রেজা ও দেবদুলাল ভৌমিক, টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি সফিক আহমেদ সাজিব ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আশরাফুল আলম চৌধুরী মামুন, চট্টগ্রাম ফটো জানালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি রাশেদ মাহমুদ ও সাধারণ সম্পাদক রাজেশ চক্রবর্তী, টিভি জানালিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি নাসির উদ্দিন তোতা, চট্টগ্রামে কর্মরত সাংবাদিক সম্মিলনী কমিটির সদস্য নওশের আলী খান, হোসাইন তৌফিক ইফতিখার, শিমুল নজরুল, রফিকুল ইসলাম সেলিম ও কামাল পারভেজ এবং চট্টগ্রামস্থ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এসএম রানা ও সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm