চট্টগ্রামে ৬ মাসে সাপের ছোবলে ৫০৩ জন, গ্রামের সাপে কাটা মানুষকে ছুটতে হচ্ছে শহরে

চট্টগ্রাম মেডিকেলে ৬ বছর ধরে ওষুধের গবেষণা চলছেই

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ছয় মাসে ৫০৩ জন সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে চট্টগ্রামের চার উপজেলা থেকে এ ধরনের রোগী বেশি এসেছেন। সাপে কামড়ের পর ওঝা, ঝাড়ফুঁক, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বারান্দা ঘুরে এসব রোগী আসেন মেডিকেলে। ততক্ষণে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে যায়। উপজেলার এসব রোগীর চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় চট্টগ্রাম শহরে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম থাকার পরও চিকিৎসকরা তা প্রয়োগ করতে চান না। ফলে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ে। মূলত অ্যান্টিভেনম দেওয়ার পর রোগীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তখনই ডাক্তার-নার্সদের একটি দক্ষ টিমের দরকার হয়—এসব সুবিধা না থাকায় উপজেলার চিকিৎসকরা এটি এড়িয়ে যান।

সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা সংশ্লিষ্টদের মতে, সাপে কাটা রোগী দু’ধরনের হয়—ভেনামাস (বিষধর সাপ) ও নন ভেনামাস (বিষহীন বা সাধারণ সাপ)। এরপর ধরণ হিসেবে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয়।

মঙ্গলবার (২৫ জুন) চট্টগ্রাম মেডিকেল সূত্রে জানা গেছে, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে এখনও পর্যন্ত ৫০৩ জন সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৪২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৩৭ জন, মার্চে ৫৫ জন, এপ্রিলে ১০৬ জন, মে-তে ১৪৭ জন, জুনে ১১৬ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এদের মধ্যে ১ জুন এক রোগীর মৃত্যু হয়েছে। মারা যাওয়া রোগী ‘কোবরা’ নামের একটি বিষধর সাপ কামড় দিয়েছিল।

মঙ্গলবার ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেছে, ৬ জন সাপে কাটা রোগী ওয়ার্ডে ভর্তি আছে।

এদিকে রোববার (৩০ জুন) মো. তাসিব নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি হয়। এইচএসসি’র বাংলা ১ম পরীক্ষা দেওয়া হয়নি তার।

তাসিব লোহাগাড়া উপজেলার পশ্চিম এলাহাবাদের মৃত আহমদ হোসেনের ছেলে। সে গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

জানা গেছে, সকালে পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে বাথরুমে যায় তাসিব। বিদ্যুৎ না থাকা অবস্থায় বাথরুমের মধ্যে সাপ তাকে কামড় দেয়। তাকে চন্দনাইশ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ফারজানা কালাম প্রাথমিক চিকিৎসার পর চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠান। বর্তমানে মেডিকেলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে সে।

এর আগে গত ২৫ জুন দুপুরে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে সাপে কাটা রোগী ফজলুল আহমেদ (৬৫) সঙ্গে কথা হয়। রাউজানের নোয়াপাড়ার বাসিন্দা ফজলুল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মসজিদে যাওয়ার উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে বের হলে সাপ কামড় দেয়। ২০ জুন এ ঘটনার পর পরই তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে আনা হয়।

১৬ নম্বর ওয়ার্ডের স্টাফ নার্স ইনচার্জ শুক্লা দত্ত চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সাপে কাটা রোগী আসার পর প্রথমত দেখা হয়, কোন ধরনের সাপ কেটেছে। এখানে বিষধর ও বিষহীন সাপে কাটা রোগী আসে। বিষধর সাপের কিছু সাইন সিমটম থাকে। সেগুলো হলো—রোগীর চোখে ঝাপসা দেখা, অস্থিরতা, মাথা ঘোরা, বমি হওয়া, কামড় দেওয়া জায়গা লাল হয়ে ফুলে যায়। বিষহীন সাপের কামড়ে কাটা রোগীরা হেঁটেই চলে আসেন ওয়ার্ডে। রোগীর স্বজনদের কেউ কেউ সাপের ছবি তুলে আনে, আবার কেউ সাপ মেরে আনে। সাপ দেখে বিষধর নাকি বিষহীন সেটি শনাক্ত করে চিকিৎসা করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিষধর সাপের কামড়ে কাটা রোগীর চিকিৎসায় নরমাল স্যালাইন ১০০ এমএল, ভেনামাস ইনজেকশন ১০(ভিয়াল) দিতে হয়। এটি কাজ না করলে বিকল্প আরেকটি ১০(ভিয়াল) ডোজ দিতে হয়। এতেও পরিবর্তন না হলে রোগীতে আইসিইউতে শিফট করানো হয়। তবে বিষহীন সাপে কাটা রোগীর ট্রিটমেন্ট আলাদা। এ রোগীর চিকিৎসায় Fluclox 500mg, Pantonix, 5%dns 1000m, 5%d/a 1000ml Normal salaine 100ml দেওয়া হয়।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের মেডিসিন বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. চৌধুরী ফরহাদ কামাল বলেন, ‘বিষাক্ত সাপের কামড়ে রোগীর মধ্যে যে লক্ষণ দেখা যায়, তা হলো—ঘাড় নেতিয়ে পড়া, চোখের পাতা পড়ে যাওয়া, নাকই সুরে কথা বলা। এর চিকিৎসায় বিষের প্রতিষেধক আ্যান্টিভেনম ইনজেকশন দেওয়া হয়। ১০টা ইনজেকশন একসঙ্গে দেওয়া হলে এটাকে একটা ডোজ বলা হয়।’

ওয়ার্ডে যেসব সাপে কাটা রোগী আসে, এর মধ্যে বিষধর কোবরা ও কালো কেউটে বা চিতার (black krait) কামড় খাওয়া রোগীই বেশি বলে জানান ডা. ফরহাদ।

তিনি বলেন, কোবরা যখন কামড় দেয়, তখন আগের লক্ষণগুলোর সঙ্গে আক্রান্ত জায়গা ফুলে যায়। আর কালো কেউটে কামড়ালে আগের লক্ষণগুলো থাকে কিন্তু আক্রান্ত জায়গা ফোলা থাকে না। আরেকটি সাপে কাটা রোগী বেশি দেখা যায়, সেটি হচ্ছে বাঁশপাতি সাপ (local venomous snake–green pit)। রোগীর মুখে এ সাপের বর্ণনা শুনে whole blood clotting test (20wbct) করা হয়।

ওঝায় ‘বন্দি’ চিকিৎসা

১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রথমে স্থানীয় ওঝার কাছে যান। ঝাড়ফুঁকে ঠিক না হলে ওই ওঝা আরেক ওস্তাদের কাছে পাঠান। সেখানেও কাজ না হলে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীর উন্নতি না হলে আনা হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে।

রোগীরা আরও জানায়, হাতে ঘড়ি বা চুড়ি, বালা থাকলে খুলে রাখতে বলেন ডাক্তাররা। কামড়ের স্থানে ঠাণ্ডা, গরম, বরফ জল বা কেমিক্যাল না দিতে বলেন। রোগীর আক্রান্ত স্থান না বাধা ও কেটে বিষ বের না করতে বলেন। কিন্তু ওঝারা উল্টো এগুলোই করেন।

১৬ নম্বর ওয়ার্ডের স্টাফ নার্স ইনচার্জ শুক্লা দত্ত বলেন, ‘উপজেলার রোগীরা, ওঝা, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক শেষে এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। ওঝা সাপে কাটা জায়গার ওপরে শক্ত করে বেঁধে দিয়ে ব্লেড দিয়ে কেটে দেয়। এব রোগী ওয়ার্ডে আসলে আরেক বিপদে পড়তে হয়। কাটা-ছেঁড়া সেলাইয়ের জন্য আবারও সার্জারি ওয়ার্ডে পাঠাতে হয়।’

উপজেলায় দেওয়া হয় না অ্যান্টিভেনম

১৬ নম্বর ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, সাপে কাটা রোগী বেশি আসে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালী উপজেলা থেকে। এছাড়া চট্টগ্রাম জেলার বাইরে ফেনী ও নোয়াখালী থেকেও বিষধর সাপের কামড় খাওয়া রোগী আসেন চট্টগ্রাম মেডিকেলে। তবে শহর এলাকা থেকে সাপে কাটা রোগী নেই বললেই চলে।

জানা গেছে, অ্যান্টিভেনম রোগীর শরীরে দিলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন রোগীকে দেখভালের জন্য ডাক্তার-নার্সের একটি বিশেষজ্ঞ টিমের প্রয়োজন। যেটি উপজেলা কমপ্লেক্সে নেই।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা না পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘চট্টগ্রামের সকল উপজেলায় সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসা সুবিধা পূর্ণাঙ্গভাবে চালু রয়েছে। প্রতিটি উপজেলাসহ অন্যান্য সেন্টারগুলোতে সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসায় যথেষ্ট অ্যান্টিভেনম মজুদ আছে। সবমিলিয়ে ৮০০ ভায়াল অ্যান্টিভেনম মজুদ রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকেরা নিরাপত্তাজনিত কারণে অ্যান্টিভেনম প্রদানে অনেক সময় বিরত থাকেন। কারণ, অ্যান্টিভেনম প্রয়োগে অনেক সময় শরীরে তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। আমদানি করা অ্যান্টিভেনমে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। রোগী মারা গেলে চিকিৎসকেরা হামলার আতঙ্কে থাকেন। তাই ঝুঁকি এড়াতে উপজেলার হাসপাতালগুলোতে অ্যান্টিভেনম দেওয়া হয় না। প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পঠানো হয়।’

ভারত থেকে আমদানি হয় অ্যান্টিভেনম

ডাক্তাররা জানান, দেশি সাপের কোনো অ্যান্টিভেনম নেই দেশে। বর্তমানে যেসব অ্যান্টিভেনম ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আমদানি হচ্ছে ভারত থেকে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সাপের ধরণ মিল না থাকায় অনেক সময় এসব অ্যান্টিভেনম কাজ করে না।

জানা গেছে, ভারত ও ইউরোপের সাপ থেকে বাংলাদেশের সাপের ধরন কিছুটা আলাদা। তাই বিদেশ থেকে আমদানি করা অ্যান্টিভেনম অনেক সময় কাজ করে না।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, ‘এজন্য দেশি সাপের অ্যান্টিভেনম জরুরি। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সাপের বিষে প্রোটিনের মাত্রা সমান নয়। তাই এসব দামি অ্যান্টিভেনমও অনেক সময় কাজ করে না।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে মূলত ভারত থেকে আমদানি করা হয় অ্যান্টিভেনম। বাংলাদেশে ২০১৮ সাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভেনম রিসার্চ সেন্টারে দেশি সাপের বিষে অ্যান্টিভেনম তৈরির চেষ্টা চলছে। আর এ কার্যক্রমের প্রধান হিসেবে আমি রয়েছি, কাজ চলছে। কিন্তু ল্যাবরেটরি সংকট, নানাবিধ সমস্যায় আমরা আশানুরূপ ফল অর্জন করতে পারিনি। সম্প্রতি একটা প্রতিবেদন আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!