চট্টগ্রাম ওয়াসায় চাকরিচ্যুত কর্মচারীর দাপট, কোটি টাকা আত্মসাতের পরও ঘুরে বেড়ান দপ্তরে
ওয়াসার মার্কেট থেকে প্রতিমাসে তোলেন ভাড়া, না দিলেই পেটান
চট্টগ্রাম ওয়াসার সাবেক কর্মচারী হয়েও অফিস সময়ে ঘোরাঘুরি করেন বিভিন্ন দপ্তরে। ওয়াসার অফিসে থাকেন গভীর রাত পর্যন্ত। নিজেকে দাবি করেন চট্টগ্রাম ওয়াসা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) নেতা। ওয়াসার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলাও দায়ের করেন তিনি। এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে ওয়াসার একটি সংগঠনের ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। যার ফলে উচ্চ আদালতের রায়ে চাকরিও হারান তিনি। কিন্তু এতেও তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তিনি ওয়াসার মার্কেট থেকে ব্যবসায়ীদের কাছ তোলেন ভাড়া। না দিলে শুরু হয় নির্যাতন, দেওয়া হয় মিথ্যা মামলাও।
তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার চাকরিচ্যুত সাবেক কর্মচারী এসএম নূরুল ইসলাম। অবৈধ দখল, চাঁদাবাজি, মারধরের হুমকিসহ অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ পুলিশ কমিশনার বরাবরে চিঠি পাঠিয়ে তার কোনো মামলা বা অভিযোগ যাতে গ্রহণ করা না হয় সেই অনুরোধও করেন।
জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৩ আগস্ট ওয়াসার তৎকালীন সচিব শারমিন আলম জেলা সমবায় কর্মকর্তাকে লিখিতভাবে অবহিত করেন যে, ‘দি ওয়াসা এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’র বর্তমান পরিচালনা কমিটির ১২ জন সদস্যের মধ্যে সাতজনের চাকরি নেই। এর মধ্যে সাধারণ সদস্য ১৬০ জনের মধ্যে ১০৩ জনের চাকরি নেই এবং অনেকে মারা গেছেন। তাই তারা সদস্যপদ হারিয়েছেন। এই সংগঠনের সভাপতি (নূরুল ইসলাম) ২০ বছর ও সাধারণ সম্পাদক ৪ বছর আগে ওয়াসার চাকরি থেকে অবসর নেন।
চিঠিতে আরও জানানো হয়, সদস্যপদ হারানোর পরও তারা অবৈধভাবে সমিতি পরিচালনা করে আসছে।
চাকরি হারানোর পর সভাপতি নূরুল ইসলামকে সমিতি পরিচালনার স্বার্থে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিষয়ে চিঠিপত্র জারি করলেও কোনো সুদত্তর দিতে পারেনি।
চিঠিতে আরও উল্লেখ হয়, সমিতির ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন নূরুল ইসলাম। তাদের হাতে সমিতির পরিচালনা ও হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ বেআইনি। ওয়সার সাবেক কর্মচারী নূরুল ইসলাম নিয়ম বহির্ভূতভাবে সমিতি পরিচালনা করছেন।
এই চিঠি এবং ওয়াসা কর্তৃক নূরুল ইসলামকে বরখাস্তের নথি চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে সংরক্ষিত আছে।
আরও জানা গেছে, নূরুল ইসলাম নিম্নমান সহকারী-কাম-টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করতেন। ২০০১ সালে তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে এবং ওই বছরই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে ২০২১ সালে নির্বাচন দিয়ে সমবায় সমিতি নতুন কমিটির কাছে ‘দি ওয়াসা এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’র দায়িত্ব দেয়। এরপরও তিনি নিজেকে ওই সমিতির সভাপতি দাবি করে আসছেন। নূরুল ইসলাম নিজেকে শ্রমিক লীগ নেতা হিসেবেও পরিচয় দেন।
দুর্নীতির মামলায় আদালতের দণ্ড ও চাকরিচ্যুতি—কিছুই দমাতে পারেনি নূরুলকে। এখনও তিনি একের পর এক ওয়াসার সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করে ভোগ করছেন।
ওয়াসা এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ সোসাইটির বর্তমান সভাপতি রেজওয়ান হোসাইন বলেন, ‘দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত নুরুল ইসলাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক ফান্ডের প্রায় ৯৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এসবের প্রতিবাদ করায় আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়েছেন। বর্তমানে তিনি পলিটেকনিক্যাল ও হালিশহরের নয়াবাজার এলাকায় ওয়াসার ২টি মার্কেট অবৈধভাবে দখল করে ভোগ করছেন।’
তিনি বলেন, ওয়াসার মার্কেটে প্রায় ২২টির মতো দোকান আছে। প্রতিটি দোকান থেকে নূরুল ইসলাম ৫-৬ ছয় হাজার টাকার মতো মাসিক ভাড়া তোলেন। ওয়াসার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের চুক্তি থাকলেও ভাড়া দিতে হয় নূরুল ইসলামকে। তাকে ভাড়া না দিলে মারধর করে, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেন। সম্প্রতি মেহেরাজুল করিম নামের ওয়াসা মার্কেটের এক ব্যবসায়ী তার মারধরের শিকার হয়েছেন।’
মেহেরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কিছুদিন ধরে দখলবাজ নূরুল ইসলাম আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে দখলের পাঁয়তারা করছেন। মালিকানা ছেড়ে দিতে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। আমরা তাকে ভাড়া না দেওয়ায় তিনি ৮ থেকে ১০ অপরিচিত লোকসহ প্রতিষ্ঠানে ঢুকে আমাকে মারধর করেন। দোকানের সাইনবোর্ড জোরপূর্বক মুছে দেন। আমার দোকানে অবৈধভাবে তিনি তালা লাগিয়ে দেন। এরপর থানায় গিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে মারধরের লিখিত অভিযোগ করেন।’
বিষয়টি নিয়ে পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন বলেও জানান এই ভুক্তভোগী।
চট্টগ্রাম ওয়াসার শ্রমিক ইউনিয়নের (সিবিএ) সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘নূরুল ইসলামের চক্রান্তে আমার বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা হয়েছে। সিবিএ’র বর্তমান যারা নেতা আছেন, তাদের বিরুদ্ধে তিনি বিভিন্নভাবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাদের ফাঁসিয়েছে। তারপরও তার শান্তি নেই। তিনি ওয়াসার কর্মচারী না, সিবিএ’র কেউ না। এরপরও ওয়াসায় দিন-রাত পড়ে থাকেন। সিবিএকে ডিঙিয়ে নানা অপতৎপরতা চালান, তদবীর বাণিজ্য করেন। আমরা তার হাত থেকে মুক্তি চাই।’
এই বিষয়ে জানতে নূরুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ওয়াসা কি কারও ব্যক্তিগত নাকি বাপ-দাদার সম্পত্তি? আমি ওয়াসাতে চাকরি করেছি। আমি কেন ওয়াসাতে যেতে পারব না? আমি আমার কার্যক্রম এখন যা করছি, তাই চালিয়ে যাব। কেউ পারলে তা প্রতিহত করুক।’
ডিজে









