চট্টগ্রাম মেডিকেলে সময়ক্ষেপণে গুরুতর রোগীদের বাঁচানো যায় না, চিকিৎসা শুরু হয় দুই থেকে চার দিন পর
সুফল মিলছে না ওয়ানস্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারে
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা স্ট্রোকের গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয় হাসপাতালের ঘাটের পর ঘাট পেরিয়ে। এ ঘাটগুলোর মধ্যে রয়েছে ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার (ওএসইসি), ১২ নম্বর সিসিইউ (কার্ডিয়াক/করোনারি কেয়ার ইউনিট)বা হৃদরোগ বিভাগ, ১৮ নম্বর নিউরো মেডিসিন বিভাগ এবং সবশেষ ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ড। এতোসব ঘাট পেরিয়ে আসল চিকিৎসা পাওয়ার জায়গায় যখন মরণাপন্ন রোগীদের ভিড় জমে যায়, তখন তাদের বেশিরভাগকেই আর বাঁচানো সম্ভব হয় না। চিকিৎসা শুরুর মাঝপথে কিংবা চলাকালীন বেশিরভাগ স্ট্রোকের রোগীই মৃত্যুবরণ করেন। চট্টগ্রামের প্রধান এই হাসপাতালে টানা কয়েকদিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে মিলেছে এর সত্যতা।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ারের (ওএসইসি) সামনে টানা দুই দিন অবস্থান নিয়ে দেখা গেল, বিশেষ করে স্ট্রোকের রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অজ্ঞান হওয়া যেসব রোগী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে, প্রথমেই তাদের খাতায় নাম এন্ট্রি করতে হয়। তারপর তাদের দেখেন জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত মেডিকেল অফিসার। আগে একজন ডাক্তার দেখে রোগীকে নিদিষ্ট ওয়ার্ডে পাঠালেও এখন ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার (ওএসইসি) হওয়ার পর এখানে মেডিসিন কিংবা কার্ডিওলজির চিকিৎসকরা রোগী দেখে তারপর সিদ্ধান্ত দেন।
দেখা গেছে, রোগীর স্বজনের কাছ থেকে কেস হিস্ট্রি শোনার পর অজ্ঞান হওয়া রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কিনা সেটা নিশ্চিত করেন চিকিৎসকরা। রোগীকে ইসিজি ও এক্সরে করতে পাঠানো হয়। এরপর অজ্ঞান ওই রোগীকেই টেনেহিঁচড়ে ট্রলিতে করে নিয়ে যাওয়া হয় রেডিওলজি বিভাগে। সেখানে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর এক্সরে করে রোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় ১২ নম্বর সিসিইউ ওয়ার্ডের এক্সরে কর্নারে।
সেখান থেকে রোগীকে আবারও নিয়ে আসা হয় জরুরি বিভাগে। তারপর ডাক্তার তাৎক্ষণিক দেওয়া এক্সরে ও ইসিজি রিপোর্ট দেখে রোগীকে পাঠান সিসিইউতে। সিসিইউতে ভর্তি হওয়ার পর রোগীকে আবার দেখে পাঠানো হয় পোস্ট-সিসিইউতে। এরপর সেখানে বুঝেশুনে ডাক্তাররা রেফার্ড করেন ২৮ নং নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে। সেখানে গিয়ে শুরু হয় আবারো রোগ পুনঃনির্ণয়। নিউরোমেডিসিন থেকে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অজ্ঞান রোগীর সিটি স্ক্যান করার পরামর্শ দেন ওয়ার্ডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তাও সেই পরামর্শ দেওয়া হয় রোগী ভর্তির পরের দিন অধ্যাপক পদবির বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রাউন্ডে আসার পর।
রাউন্ড শেষে সিটিস্ক্যান করার জন্য রোগীকে প্রাইভেট ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হয়। ট্রলিতে করে সেই রোগীকে ওঠানো, লিফটে করে নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্স কিংবা সিএনজিতে প্রাইভেট ল্যাব পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে আর ফিরিয়ে আনতে চলে যায় দিনের পুরোভাগ। এর মধ্যে চলে যায় দেড় থেকে দুই দিন। মাঝে শুক্রবার পড়লে সেটা হয়ে দাঁড়ায় তিন কিংবা চারদিনে। তারপর সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট দেখে রোগীর স্ট্রোক বা মস্তিস্কে রক্তক্ষরণ চিকিৎসকরা নিশ্চিত হলেও রোগীকে আর মৃত্যুমুখ থেকে ফেরানো সম্ভব হয় না।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারের মেডিকেল অফিসার ডা. নিবেদিতা ঘোষ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রোগের বর্ণনা দিতে রোগীরা ভুল করে। আমরা তারপরও তাদের কথার ওপর ভিত্তি না করে বর্তমানে ইমারজেন্সি কেয়ার থেকেই প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাগুলো সম্পন্ন করাই। তারপর রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় রোগীর চাপ বেশি থাকলে রোগীর কেসস্টাডি ভালো করে শোনা সম্ভব হয় না। তখন কিছু ভুল হতে পারে।’
সুফল মিলছে না ওয়ানস্টপ ইমারজেন্সি কেয়ারে
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওয়ানস্টপ ইমারজেন্সি কেয়ার (ওএসইসি) চালু হয়েছে গত ৪ সেপ্টেম্বর। হাসপাতালে সেবা নিতে আসা রোগীরা ওএসইসিতে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে অসুস্থতার মাত্রার ভিত্তিতে প্রাথমিক ও বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা পাবেন বলে জানানো হয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে।
জরুরি রোগী চিহ্নিত করে রিসাসসিটেশন, জরুরি ল্যাব পরীক্ষা, ইসিজি, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও আলট্রাসাউন্ড, টিকেট কাউন্টার, একিউট ট্রিটমেন্ট, বিশেষজ্ঞ রোগীদের রোগীদের চিকিৎসকের সার্বক্ষণিক সেবা, আন্তঃবিভাগে ভর্তি, বর্হিবিভাগে রেফার, ছাড়পত্র, মৃতদেহ সংরক্ষণ, জরুরি মেডিসিন ও শল্যসেবা এবং রোগী ভর্তি কার্যক্রম পরিচালিত হবে বলেও ওএসইসি থেকে জানানো হয়।
কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হয়, ওএসইসিতে ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার, ইন্টারনাল মেডিসিন, সার্জারি, অর্থোপেডিক, হৃদরোগ, শিশু, নিউরোমেডিসিন ও আইসিইউ বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। পাশাপাশি রেডিওলজিস্ট ও প্যাথলজিস্টরাও সেবা দেবেন। চট্টগ্রাম মেডিকেলের এই ওএসইসিতে চার কোটি টাকার মেডিকেল যন্ত্রপাতি, আসবাবপত্র ও অ্যাম্বুলেন্স দেয় চিটাগাং ক্লাব লিমিটেড। কিন্তু সেই অর্থে রোগীদের তেমন একটা সুফল মিলছে না ওএসইসি থেকে। বিশেষ করে স্ট্রোকের রোগীদের অবস্থা হয় খুবই করুণ।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে স্নায়ুরোগ সংক্রান্ত রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। আর ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে স্ট্রোক, হেড ইনজুরি, মেরুদণ্ডের ইনজুরি, নার্ভ ইনজুরি, ব্রেন টিউমার ও শিশুদের জন্মগত ত্রুটির চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি ক্লিনিক্যাল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর মধ্যে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ রোগীই ব্রেন স্ট্রোকের রোগী। কিন্তু এসব রোগী মেডিকেলে আসে কয়েক ঘাট পেরিয়ে। প্রথমে একজন ব্রেন স্ট্রোকের রোগী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসে। সেখানে প্রাথমিক নামমাত্র পর্যবেক্ষণ শেষে রোগীকে ১২ নম্বর সিসিইউতে পাঠানো হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যখন জানা যায়, রোগীর ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে— তখন এর মধ্যেই পেরিয়ে যায় তিন দিন। এই তিন দিন পর রোগী যখন ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে আসে, তখন তার চিকিৎসার সময়সীমা কার্যত শেষ। শেষ পর্যন্ত সেই রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না।’
টানা দুই দিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১২ নম্বর সিসিইউ ওয়ার্ডে গিয়ে কথা হয় অন্তত ১০ জন রোগীর সঙ্গে। ফটিকছড়ির কাঞ্চননগর থেকে আসা আবু সোলায়মান হঠাৎ করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে তাকে স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়। কয়েকদিন ধরে তার মাথাব্যথা ছিল। পরে সেখান থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পাঠানো হয়। জরুরি বিভাগ দিয়ে ১২ নং ওয়ার্ডে ভর্তি হওয়ার পর টানা দুদিন ওয়ার্ডেই পড়ে থাকেন তিনি। তৃতীয় দিন ডাক্তারদের রাউন্ড শেষে তাকে কিছু পরীক্ষা দেওয়া হয়। চতুর্থ দিনে ডাক্তাররা নিশ্চিত হন আবু সোলায়মানের ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। এরপর ওইদিন বিকেলে তাকে পাঠানো হয় ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে। ততোক্ষণে পেশায় মুদি দোকানদার সোলায়মানের অবস্থা করুণ থেকে করুণতর হয়ে উঠে।
হৃদরোগ বিভাগে স্ট্রোকের রোগী ভর্তি প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. আমিষ দে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ভুলটি জরুরি বিভাগ করে। আমাদের কাছে রোগী আসার পর আমরা প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হই রোগী স্ট্রোক করেছে। তখন তাকে নিউরোমেডিসিন কিংবা নিউরোসার্জারিতে রেফার্ড করানো হয়।’
এদিকে শয্যার পাঁচগুণ বেশি রোগীর চাপ, পুরনো অপারেশন থিয়েটার ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আর আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবসহ নানা সমস্যায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি ওয়ার্ড। রোগীর বড় একটি অংশ শিশু হলেও তাদের জন্য নেই আলাদা ব্যবস্থা। চট্টগ্রামের ১০ জেলার ৫ কোটি মানুষের নিউরোসার্জারি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচারের একমাত্র ভরসাস্থল এই ওয়ার্ড।
সড়ক দুর্ঘটনা, মাথায় আঘাত, ব্রেন টিউমার, স্ট্রোকসহ নিউরোসার্জারি চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার ব্যয়বহুল হওয়ায় জনসাধারণের জন্য চমেকের এই ওয়ার্ডটির গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বাড়লেও চিকিৎসা সরঞ্জাম ও শয্যার কারণে মিলছে না উপযুক্ত চিকিৎসা।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই ওয়ার্ডে নেই কোনো অপারেটিং মাইক্রোস্কোপ, নিউরো-এন্ডোস্কোপ, নিউমেটিক ড্রিল মেশিন। এগুলো না থাকায় চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা থাকলেও জটিল অস্ত্রোপচার পুরোপুরি সম্ভব হয় না।
সিপি