ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই মাথাচাড়া দিচ্ছে শরীরের অন্য সংক্রমণ, দেরীতে পরীক্ষায় বাড়ছে বিপদ

ছয় বছরের শিশু নেহালের জ্বর আক্রান্ত হওয়ার তৃতীয় দিন পর ডেঙ্গু ধরা পড়ে। তাকে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। কিন্তু আগে থেকেই তার ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা ছিল। তিন বছর বয়সে তার একবার নিউমোনিয়াও হয়েছিল। তখন ১৫ দিনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছিল। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর আবারও তার দেখা দেয় নিউমোনিয়া। জেনারেল বেড থেকে তাকে আইসিইউতেও নেওয়া হয়েছিল। নিউমোনিয়াতে আক্রান্তদের অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ডেঙ্গুর কারণে চিকিৎসা দিতে বেগ পেতে হয় ডাক্তারদের। শেষ পর্যন্ত সুস্থ হলেও ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়ার ধকলে কাহিল হয়ে পড়ে নেহাল।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন নোয়াখালীর বাসিন্দা সফুরা বেগম। আটদিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি তিনি। শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) কথা হয় সফুরার সঙ্গে। তিনি জানান, তার পরপর তিনটি মেয়ে। ছোট মেয়ে জন্মের সময় বাড়িতে ডেলিভারি করতে গিয়ে তার জীবন সংকটাপন্ন হয়ে গিয়েছিল। তখন জরায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর মাঝে মাঝেই তার তলপেটে ব্যথা করতো, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হতো। পরে নোয়াখালীর একজন গাইনি ডাক্তারকে দেখিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা যায়, তার জরায়ুতে টিউমার। ডাক্তার অপারেশনের কথা বললেও তা এখনও করা হয়নি। কিন্তু এর মধ্যে মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে হাজির হয় ডেঙ্গু।

সফুরা বেগম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর আবারও তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। আগের রিপোর্ট দেখে ডাক্তার জানান, ডেঙ্গু নেগেটিভ হলে সফুরাকে গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরনাপন্ন হতে হবে। এদিক জ্বরের পাশাপাশি তার দেখা দিয়েছে ইউরিন ইনফেকশনও। ডেঙ্গুর নেগেটিভ না হওয়ার পর্যন্ত তার অন্য রোগের চিকিৎসা করা যাচ্ছে না।

সফুরার মতো অনেক রোগীর এভাবে ডেঙ্গুর চাপে আড়ালে থাকছে শরীরের অন্য সংক্রমণ। ডেঙ্গু সামলাতে গিয়ে অন্য রোগের চিকিৎসা করানো যাচ্ছে না। ফলে খারাপ হচ্ছে রোগীর অবস্থা। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বলছেন, ডেঙ্গুর আক্রান্ত রোগীদের অন্যান্য সমস্যা দেখা দিলে অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। কিন্তু ডেঙ্গুর কারণে সেসময় তা দেওয়া যায় না। ফলে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে অন্য রোগ। তাই শুরুতে বিভিন্ন পরীক্ষা মাধ্যমে কোনো ইনফেকশন আছে কি-না তা শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎসা দ্রুত শুরু করা যায়।

এদিকে চট্টগ্রাম জেলায় গত চার বছরে তুলনায় এবছর বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মৃত্যুও হয়েছে বেশি। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মাত্র ১৭ জন। ওই বছর কোনো রোগীর মৃত্যু হয়নি। পরের বছর ২০২১ সালে রোগী বেড়ে যায় ১৬ গুণ, ভর্তি হন ২৭২ জন। মারা যান পাঁচজন।

Yakub Group

গত বছর হাসপাতালে ভর্তি হন ৫ হাজার ৪৪৫ জন, মৃত্যু হয় ৪১ জনের। আর চলতি বছরের শুরু থেকে রোববার (১৭ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ৪৮৯ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬৬ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১৪৩ জন।

বিশেষ করে আগস্ট মাস থেকে সংখ্যাটা বাড়ছে লাফিয়ে। একদিকে ডেঙ্গু, অন্যদিকে শরীরে লুকিয়ে থাকা অন্য সংক্রমণ। তাই জ্বর সারাতে গিয়ে বেগ পেতে হচ্ছে ডাক্তারদের।

সংশ্লিষ্ট ডাক্তাররা জানান, যদি প্রতিদিন ১০ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়, তার মধ্যে তিন থেকে চারজনের দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গু ছাড়াও অন্য সংক্রমণ রয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। এছাড়া মধ্য বয়সী ও বয়স্ক রোগীরা শরীরের অন্য রোগ গুরুত্বের সঙ্গে নেন না। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর অন্য রোগ যখন শনাক্ত হচ্ছে, তখন রোগীর অবস্থা খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। যেমন মহিলাদের ইউরিন ইনফেকশন রয়েছে, কারও নিউমোনিয়া, কারও ইনফ্লুয়েজ্ঞা কিংবা টাইফয়েড। আবার ফ্যাটি লিভার, কিডনি, ডায়াবেটিক জটিলতা, হৃদরোগসহ নানান রোগ মাথাচাড়া দিচ্ছে ডেঙ্গুর সঙ্গে।

ডেঙ্গু হলে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার দরকার নেই। অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণে অ্যান্টিবায়োটিক না দেওয়া পর্যন্ত জ্বর কমবেই না। এই কারণেই ডেঙ্গুর ওষুধ চললেও জ্বর কমছে না। তখন রোগীর আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ধরা পড়ছে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনও রয়েছে। এই অন্য সংক্রমণের কারণে অধিকাংশ ডেঙ্গু রোগীর জীবন সংকাটপন্ন হয়ে উঠছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৯ নম্বর শিশু ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. সৌরভ রায় চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনও ভূমিকা নেই। তাই ডেঙ্গুর ট্রিটমেন্ট চলাকালীন নিউমোনিয়া বা ইনফ্লুয়েঞ্জা, যা থেকে সেপসিসের ঝুঁকি দেখা যাচ্ছে (রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাওয়া) বা অন্য কোনও সংক্রমণের জ্বর থাকলে সেটা কমে না। তখন অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার প্রয়োজন। তাই অনেকের ক্ষেত্রেই জ্বর সারছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এনএস ওয়ান পজিটিভ হওয়া মানে রোগীর ডেঙ্গু হয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কিছু রোগীর অ্যান্টিবডি পাওয়া যাচ্ছে না। এটাই অ্যালার্মিং। তখনই বুঝতে জ্বরের আড়ালে শুধু ডেঙ্গু নয়, অন্য কিছুও রয়েছে। ডেঙ্গু থাকার পরও প্রোক্যালশিটোলিন বেশি হলে তখন বুঝতে হবে একজনের ডেঙ্গুর সঙ্গে অন্য সংক্রমণ বা ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন রয়েছে। একইসঙ্গে এই সময় ডেঙ্গু চলাকালীন টাইফয়েডও আক্রমণ করছে। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যাটাও বেড়েছে। ডেঙ্গু না হয়ে ম্যালেরিয়া কি-না, সেটাও টেস্ট করে দেখা দরকার।’

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. এইচএম হামিদুল্লাহ মেহেদি বলেন, ‘জ্বর হলে শুধু ডেঙ্গু নয়, সঙ্গে ইউরিন কালচার ও ব্লাড কালচার টেস্ট করে দেখা উচিত। তাহলেই অন্য সংক্রমণ থাকলে ধরা পড়বে। এতে ট্রিটমেন্টেও সুবিধা এবং রোগী সুস্থ হবেন দ্রুত। তা নাহলে একটার ট্রিটমেন্ট করতে গিয়ে অন্যটার হয় না। যখন ধরা পড়ে তখন অনেক দেরী হয়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ডেঙ্গু চিকিৎসার পাঁচদিন পরও জ্বর যদি না কমে তখন সিআরপি (সি রি-অ্যাকটিভ প্রোটিন) টেস্ট করে দেখতে হবে। আর প্রোক্যালশিটোনিন টেস্ট করে ব্যাকটিরিয়া শরীরে রয়েছে কি-না সেটাও নির্ণয় করতে হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!