যুবলীগ নেতা বদির প্রশ্রয়ে পটিয়ায় আত্মহত্যা-নাটক ‘সন্ত্রাসী’ জমিরের
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ না মেনে এমপির বিরুদ্ধে হুঙ্কার
চট্টগ্রামে পটিয়ায় কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা বদিউল আলম বদির আয়োজিত মতবিনিময় সভায় হুইপ সামশুল হকের বিষদগার করেছেন ২৯ মামলার আসামি ডিএম জমির উদ্দিন। হুইপ সামশুলকে আবারও মনোনয়ন দিলে তিনি সপরিবারে আত্মহত্যার হুমকি দেন। এসময় মুচকি হেসে তার কথায় সমর্থন দিলেও কর্মীর এমন আচরণের দায় নিতে চাননি বদি।
বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) পটিয়া উপজেলার পোস্ট অফিস মোড়ে একটি রেস্টুরেন্টে যুবলীগ নেতা বদিউল আলম বদির উদ্যোগে আয়োজিত সভায় জমির উদ্দিন একথা বলেন।
এদিকে ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বদি। সভায় তিনি বলেন, ‘যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ও পটিয়ার বর্তমান এমপি দু’জনেই অন্য একটি দল করতেন। কিন্তু তিনি ’৯০ সাল থেকে এই দলে আছেন।’ তাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বদির এমন বক্তব্য ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে পটিয়া আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা বলেছেন, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বদির এমন বক্তব্য এমপিদের নিয়ে সমালোচনা বা করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশকে উপেক্ষা করার সামিল।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম বদি বলেন, ‘এটা জমির উদ্দিনের ব্যক্তিগত বিষয়। তার ইমোশনের জায়গা থেকে তিনি বলতে পারে, এই বিষয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন। তার এমন কথার দায়িত্ব আমি নেবো না। এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। এই বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম শামসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, ‘যারা যোগ্য তারাই নমিনেশন চাইবে। সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া একজন এমপির বিরুদ্ধে এই ধরনের মন্তব্য করা উচিত না। দলে ভিন্নমতের মানুষ থাকতে পারে, তবে এই ধরণের কথা বলা যাবে না। নির্বাচন আসলে জমির এসব করেন, আগেও তিনি এমন করেছেন।’
তিনি বলেন, ‘জমিরের পাহাড়ি কর্মী বাহিনী ছিল। তিনি জননন্দিত কোনো নেতা না। তবে তিনি দলের কর্মী। তিনি কোনোদিন কোনো পদে ছিলেন না, এখনও নেই। তিনি একটু ইমোশনাল মানুষ। তার জনপ্রিয়তার কোনো প্রশ্নই আসে না। এছাড়া সন্ত্রাসী ও রোহিঙ্গাদের জন্য দলে কোনো জায়গা নেই। আমরা এসবে প্রশ্রয় দিই না। জমির দলের একটিভ কর্মীও না। এছাড়া সাধারণ মানুষের কাছে তাদের মত মানুষের জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অনেক মামলাও ছিল।’
বদিউল আলম বদি তাদের উস্কে দেয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘উনার কাজ যুবলীগে। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি এসে ডিস্টার্ব করে। উনার কাজই হলো দলকে বিভ্রান্ত করা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা। এসব লোকজনকে নিয়ে আমরা আলোচনাও করি না।’
এলাকাবাসীর অভিযোগ, ডিএম জমিরের একাধিক সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপের সশস্ত্র সদস্যরা পটিয়া, চন্দনাইশ ও বোয়ালখালীতে ভয়ঙ্কর সব অপরাধ সংঘটিত করছে। খুন, অপহরণ, ডাকাতি, জায়গা দখল, চাঁদাবাজি, চুরি ও ছিনতাই তাদের রুটিন ওয়ার্ক।
পাহাড়েও সমতলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন ডিএম জমির উদ্দিন এবং তার সেকেন্ড ইন কমান্ড বালু সাইফুল ও উইথপ্রু মারমা। পাহাড়ের ত্রাস উইথপ্রু মারমা, আর সমতলে বালু সাইফুল। তাদের গ্রুপের সন্ত্রাসীরা দিনদুপুরে চালক, কৃষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকে ধরে গভীর জঙ্গলে নিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। এছাড়া জমিরের সঙ্গে সম্প্রতি সময়ে যুক্ত হয়েছে গ্যাং লিডার কিং মাসুদ, গুটি হাসান এবং পিস্তল রাজু।
জানা গেছে, ২০২০ সালে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা চাঁদার জন্য পটিয়া থেকে মোসলেম উদ্দিন নামের একজনকে অপহরণ করেন নিয়ে যায়। তিন বছরেও পুলিশ মোসলেমের খবর পায়নি। এছাড়া ডিএম জমির উদ্দিন, বালু সাইফুল ও উইথুপ্রু মারমা মিলে পাহাড়ি মদ এনে পটিয়াসহ আশপাশের উপজেলায় বিক্রি করেন। পাহাড়ে তাদের রয়েছে একাধিক সন্ত্রাসী আস্তানা। দল ভারী করতে স্থানীয় কিশোরদের গহীন পাহাড়ে নিয়ে উইখুপ্রু মারমা অস্ত্র চালনাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রশিক্ষণ দেন।
ডিএম জমির উদ্দিনের কিশোর গ্যাং লিডার দিহানের নেতৃত্বেও রয়েছে কয়েকশ কিশোরের বড় গ্যাং। সদর এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে তারা চুরি, ছিনতাই, মাদক বেচাকেনা করে। দিহান পটিয়া থানার একাধিক মামলার আসামি সাবেক কমিশনার আবদুল মান্নানের ছেলে। উপজেলার কমল মুন্সির হাট থেকে গ্যারেজ কর্মচারী আবদুল গফুরকে ছুরিকাঘাত করে দেড় লাখ টাকা নিয়ে যান দিহান ও তার গ্রুপের সদস্যরা। কিশোর গ্যাং লিডার দিহানের ভয়ে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করার সাহস পায় না।
অন্যদিকে জমিরের অনুচর কিসলো গ্রুপের মোটা আনিস, পিস্তল ফারুকের মূল কাজ জায়গা দখল। এছাড়া পটিয়া থানার পাশে বেরাজ্জা কলোনিতে গাঁজা ও ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও চালান। ২০২১ সালের জুলাইয়ে মুজিববর্ষ উপলেক্ষে পটিয়ার হাইদগাঁও গুচ্ছগ্রামে গৃহহীনদের জন্য নির্মিত প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরও ভাঙচুর করে তারা। এই ঘটনায় ৪ আগস্ট প্রকল্প কর্মকর্তা সুপ্তশ্রী সাহা ও ঠিকাদার আবুল হাসান বাদি হয়ে সাইফুল ইসলাম ওরফে বালু সাইফুল ও সাইফুদ্দিন ভোলার নামে পৃথক দুটি প্রসিকিউশন মামলা করেন।
এলাকাবাসীর আরও অভিযোগ করেন, জাহিদ হাসান হৃদয় নামের এক পিকআপ চালককে অপহরণ করে বেদম মারধর করা হয়। এই ঘটনায় পটিয়া থানায় মামলা দায়ের করেন জাহিদ হাসানের পরিবার। মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য বাদির পরিবারকে চাপ প্রয়োগ করতে একই বছরের ১৯ এপ্রিল রাতে আমজুরহাট এলাকায় ডিএম জমির উদ্দিন, এয়ার মোহাম্মদ, বালু সাইফুলসহ ১০-১৫ জনের একটি দল মোটরসাইকেল নিয়ে শোডাউন দেয়। এই সময় ক্ষুব্ধ স্থানীয় লোকজন তাদের ধাওয়া করে। জনরোষ থেকে বাঁচতে বালু সাইফুল গুলি ছুঁড়ে কোনো রকমে পালিয়ে যান।
রাতের আঁধারে এই ঘটনায় ডিএম জমির উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন। গণধোলাইয়ে আহত হন বালু সাইফুল ও ইকবাল হোসেন। তবে তারা এই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ‘নাটক’ সাজান। তারা প্রচার করেন, ইফতার মাহফিলে দাওয়াত করতে যাওয়ার পথে স্থানীয় এমপি সামশুল হক চৌধুরীর ভাই নবাবের লোকেরা তাদের ওপর গুলি ছুঁড়েছে। এরপর পটিয়ায় রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করে সন্ত্রাসী জমির গ্রুপ।
এই ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে তারা সাজান ‘ব্রাশফায়ার’ নাটক। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতেই এমন নাটক সাজানো হয়েছে—বলছে খোদ পুলিশই।
ডিজে