s alam cement
আক্রান্ত
৯৭৯৬২
সুস্থ
৬৬৫৬৪
মৃত্যু
১১৯৬

পাঠ্যবইয়ে ‘অপারেশন জ্যাকপট’ পড়ানো নিয়ে বিতর্কে সাংসদ-মন্ত্রী-সচিব

0

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অন্য আরও তিন বন্দরের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরেও পরিচালিত সফলতম গেরিলা অপারেশন ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে বিতর্ক হয়েছে। এমন সামরিক অভিযানের ঘটনা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে যু্ক্ত করার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা।

এ নিয়ে বিতর্কে অবতীর্ণ হন মন্ত্রী, সংসদীয় কমিটির সভাপতি, সংসদ সদস্য ও সচিব। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

বিতর্কের এই ঘটনা ঘটেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে। কমিটির ১৯তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নৌ-কমান্ডো বাহিনীর পরিচালিত প্রথম অভিযান ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। ১৯৭১ সালের ১৬ আগস্ট প্রথম প্রহরে দেশের দুটি সমুদ্রবন্দর— চট্টগ্রাম ও মোংলা, এবং দুইটি নদী বন্দর— চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে একই নামে পরিচালিত অপারেশনগুলো চালানো হয়েছিল।

সংসদীয় কমিটির ১৮তম বৈঠকে সুপারিশ করে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নৌ-কমান্ডোদের পরিচালিত অপারেশন জ্যাকপট অধ্যায়টি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তসহ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এ রকম আরও ঐতিহাসিক সামরিক অভিযানের ঘটনা পাঠ্যসূচিভুক্ত করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে।

কিন্তু কমিটির বৈঠকে এর বিরোধিতা করেন চাঁদপুর-৫ আসনের এমপি মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম। তিনি বলেন, এগুলো মিলিটারি অপারেশন। পৃথিবীর কোনো দেশে আজ পর্যন্ত নরমাল একাডেমি কারিকুলামে এসব অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এগুলো সামরিক বাহিনীর কাজ। তারা স্টাফ কলেজ ও টেকনিক্যাল কলেজে পড়াতে পারে।

Din Mohammed Convention Hall

কমিটি থেকে এ ধরনের সুপারিশ না দেওয়ার বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যে খণ্ডের দলিল আছে সেখানে জ্যাকপট আছে। এর বাইরে অনেকেই বই লিখেছেন। কমান্ডোগণ লিখেছেন। এখন পাঠ্যপুস্তকে কোনটা অন্তর্ভুক্ত হবে? ছেলে-মেয়েরা কোনটা পড়বে? তারা কি এগুলো পড়বে, না তাদের ক্যারিয়ার গড়বে? অপারেশন জ্যাকপট সম্পর্কে বিভিন্ন বইয়ে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই বর্তমানে এগুলো পাঠ্যপুস্তকে ঢোকানোর কোনো কারণ নেই। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো পুরো ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা।

রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম বলেন, প্রতিটি সেক্টরে মূল যুদ্ধগুলোর নাম দিয়ে সংক্ষেপে ১০টা সেক্টরের যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধগুলোকে ১০টি ভাগে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেন চট্টগ্রাম-৮ আসনের এমপি মোছলেম উদ্দীন আহমদ। তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তকে যদি আসতে হয় তাহলে টোটাল মুক্তিযুদ্ধের ওপর ইতিহাস সংক্ষিপ্ত আকারে বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে মোছলেম উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সম্পূর্ণ যুদ্ধটাই কিন্তু ছিল গেরিলা যুদ্ধ। সম্মুখ যুদ্ধও হয়েছে। তবে বেশির ভাগ যারা জীবন বিপন্ন করে দেশের ভিতর থেকে হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে, তাদের এরূপ বিষয়ে অনেক বীরত্বপূর্ণ কাহিনী আছে। যা মিডিয়ার কারণে কিছু কিছু এলেও সবগুলো আসছে না।

খণ্ডিত আকারে বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে না এনে সামগ্রিকভাবে আনার বিষয়ে একমত পোষণ করে তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ কোনো ধর্মযুদ্ধ ছিল না। এটা একটা জনযুদ্ধ ছিল। সর্বস্তরের মানুষ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্যকে তাদের বীরত্বের জন্য সর্বোচ্চ খেতাব দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত তৎকালীন সরকার এটার প্রতি মনোযোগ দেয়নি। যারা গেরিলা যুদ্ধে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছে তাদের মধ্যে বেসামরিক লোকদেরকে কোনো রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হয়নি। এ ধরনের বেসামরিক বীরত্বপূর্ণ দুর্ধর্ষ যোদ্ধাদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া যায় কি না সে বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

এছাড়া পাঠ্যপুস্তকে যুদ্ধের বিস্তারিত না রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন কমিটির অপর সদস্য ঢাকা-৬ আসনের এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ। বৈঠকে তিনি বলেন, আমাদের পাঠ্যপুস্তকে যুদ্ধের বিস্তারিত না দিয়ে বা যুদ্ধের কৌশল না বুঝিয়ে শুধু কোথায় কোথায় কতগুলো যুদ্ধ হয়েছিল সেগুলো পাঠ্যপুস্তকে থাকলে ছেলেমেয়েরা জানতে পারবে যুদ্ধগুলো কিভাবে হয়েছিল। যুদ্ধটা জনযুদ্ধ হলেও এর নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। সেখানে ইপিআর, পুলিশ, ছাত্র-জনতা সবাই অংশগ্রহণ করেছে। এগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠ্যপুস্তকে দেওয়া যায়।

অন্যদিকে অপারেশন জ্যাকপটের মতো গেরিলা অপারেশনগুলো পাঠ্যপুস্তকে রাখার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এবং ওই মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া।

বৈঠকে মন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের যে গৌরবগাঁথা আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাবৃন্দ যে সকল দৃষ্টান্তমূলক বা জাতিকে অনুপ্রাণিত করার মতো যুদ্ধ করেছে সেগুলো জাতি যেন অবহিত হতে পারে। নৌ-কমান্ডো যদিও একটা গুরুত্বপূর্ণ তার সাথে নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, পদাতিক বাহিনী, গেরিলা বাহিনীর ঘটনাগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে কতগুলো যুদ্ধ আছে যা সর্বজনবিদিত, বীরত্বগাঁথা বা ঘটনাগুলো যাতে শিক্ষার্থীরা জানতে পারে সে লক্ষ্যেই পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কীভাবে মানুষ হত্যা করেছে এবং তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শাম্‌স কীভাবে লুটপাট করেছে, মানুষের বাড়ি পুড়িয়েছে এগুলো পড়াতে এবং জানাতে হবে বলে তিনি অভিমত জানান।

এই মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া বৈঠকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে প্রোগ্রামগুলোর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিদিন নামে একটি অনুষ্ঠান ৭ জুন থেকে টেলিভিশনে প্রচারিত হচ্ছে। এই ‘প্রতিদিন’-এ অনুপ্রাণিত করার মতো এবং যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করার মতো ঘটনাগুলো দেখানো হয়। এর মধ্যে জ্যাকপটও আছে।

তিনি বলেন, ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উপর বহু ছবি নির্মাণ হয়েছে। তাই জ্যাকপটও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

এসব বিতর্কের পর সংসদীয় কমিটির সভাপতি শাজাহান খান বৈঠকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ একটি সাধারণ ও রাজনৈতিক যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক চেতনা ও সামরিক চেতনা এক নয়। সেখানে একটি আদর্শের ভিত্তিতে আমরা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। সামরিকযুদ্ধ নিয়ে বহু দেশে বই লেখা হয়েছে। বাংলাদেশেও সামরিক বাহিনীর কিছু সদস্য বিভিন্ন কাজে ও পরিকল্পনায় সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। অপারেশনগুলো করেছেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং আমাদের দেশের কৃষক-শ্রমিকের সন্তানেরা।

বাঙালি নৌ-কমান্ডোদের অপারেশন সম্পর্কে তিনি বলেন, এত বড় একটা যুদ্ধ তা আমরা সকলে জানি না কিভাবে যুদ্ধ হলো। ৫০ বছর কেন, ১০০ বছর পরও ইতিহাস জানতে হলে পড়াতে হবে। শুধু এই যুদ্ধ নয়, অন্যান্য যুদ্ধের ঐতিহাসিক ঘটনা সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠ্যপুস্তকে থাকা দরকার। অপারেশন জ্যাকপটের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলো এবং মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম যে কথা বললেন পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সিদ্ধান্তটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। শিক্ষা নীতিমালা অনুযায়ী তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ManaratResponsive

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm