কর্মচারীকে দিয়ে ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, ছেলে-ভাইসহ দুদকের মামলায় এস আলম
পরিবারের ১২৫ ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
দেশের বিতর্কিত শিল্পগ্রুপ এস আলমের বিরুদ্ধে আবারও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ, তার বড় ছেলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম এবং তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) দুদকের অনুসন্ধান টিম কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল ও মামলা দায়েরের সুপারিশ করলে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান এস আলমের বড় ছেলে আহসানুল আলমসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়। চট্টগ্রামের সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ বাদি হয়ে মামলা করেন সংস্থাটির উপপরিচালক (অনুসন্ধান টিম লিডার) ইয়াসিন আরাফাত।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাইফুল আলম মাসুদের বড় ছেলে আহসানুল আলমের নেতৃত্বে ১ হাজার ৯২ কোটি টাকা অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা হয়েছে। এস আলম গ্রুপের বেতনভুক্ত কর্মচারী মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী পটিয়ার খরনা ইউনিয়নের গোলাম সারওয়ার চৌধুরী মুরাদকে সামনে রেখে গত তিন বছরে ওই টাকা হাতিয়ে নেয় গ্রুপটি।
প্রতিবেদনটিতে আরও বলা হয়েছে, টাকা লুটপাটে সহযোগিতা করেন ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি ও পরিচালকসহ ৩৪ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। এসব কর্মকর্তার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিক মিলে মোট ৫৮ জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিশন থেকে মামলা দায়েরের অনুমোদনের পর মামলা হয়েছে। যেখানে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলমকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। পাশাপাশি তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান, এমডি, একাধিক পরিচালকসহ ৫৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হলেন—ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আহসানুল আলম, সাবেক পরিচালক ও ইসি কমিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ডা. তানভীর আহমদ, ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক ড. মো. ফসিউল আলম, কাজী শহীদুল আলম, ড. মো. সিরাজুল করিম, জামাল মোস্তফা চৌধুরী, মো. জয়নাল আবেদীন, সাবেক পরিচালক খুরশীদ উল আলম, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক ড. মোহাম্মদ সালেহ জহুর ও মোহাম্মদ সোলায়মান, পরিচালক মো. কামরুল হাসান ও সাবেক নমিনী পরিচালক সৈয়দ আবু আসাদ।
এছাড়াও আসামি করা হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল মাওলা, ইসলামী ব্যাংকের সাবেক অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী, কেকিউএম হাবিবুল্লাহ, ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি ও চিফ হিউম্যান রিসার্চ অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, মিফতাহ উদ্দিন, মোহাম্মদ আলী ও মোহাম্মদ সাব্বির, সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী মো. রেজাউল করিম, বর্তমান উপব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল ইসলাম, সাবেক এসইভিপি ও এএমডি মো. আলতাফ হোসেন, এসইভিপি জিএম মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, আবু ছাঈদ মুহাম্মদ ইদ্রিস ও সাবেক এসইভিপি মোহাম্মদ উল্লাহ, ব্যাংকটির বিনিয়োগ প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. ফরিদ উদ্দিন, ইসলামী ব্যাংকের কক্সবাজার শাখার ম্যানেজার আমান উল্লাহ, চট্টগ্রামের চাকতাই শাখার সাবেক ম্যানেজার ও বর্তমানের এফএভিপি মোহাম্মদ আলী আজগর, চাকতাই শাখার সাবেক বিনিয়োগ ইনচার্জ খাজা মোহাম্মদ খালেদ, চাকতাই শাখা প্রধান ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. মনজুর হাসান, ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জোনের প্রধান মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী এবং দক্ষিণের অপর জোনপ্রধান ও এসইভিপি মিয়া মোহাম্মদ বরকত উল্লাহ।
ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের মালিক হিসেবে আসামি করা হয়েছে মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক পটিয়ার খরনার গোলাম সওয়ার চৌধুরী মুরাদ, চৌধুরী অ্যান্ড হোসাইন ট্রেড লিংকের মালিক মোহাম্মদ এরশাদ হোসাইন চৌধুরী, বিসমিল্লাহ ট্রেডিং কর্পোরেশানের মালিক মোরশেদুল আলম, মেসার্স ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সে মালিক মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী, চেমন ইস্পাত লিমিটেডের পরিচালক মুহা. নজরুল ইসলাম, ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরিফুল ইসলাম চৌধরী, পরিচালক মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান, রেইনবো কর্পোরেশনের মালিক রায়হান মাহমুদ চৌধুরী, আনছার এন্টারপ্রাইজের মালিক আনছারুল আলম চৌধুরী, সোনালী ট্রেডার্সের মালিক সহিদুল আলম, ফেমাস ট্রেডিং কর্পোরেশনের মালিক আরশাদুর রহমান চৌধুরী, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশনের এমডি মো. রাশেদুল আলম, পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর, গ্রিন এক্সপোজ ট্রেডার্সর মালিক এম এ মোনায়েম, কোস্টলাইন ট্রেডিং হাউজের মালিক এরশাদ উদ্দিন, জাস্ট রাইট ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মো. গিয়াস উদ্দিন, এক্সক্লুসিভ বিজনেস হাউজের মালিক ফেরদৌস আহম্মদ বাপ্পি, এনেক্স বিজনেস কর্নারের মালিক আনোয়ারুল আজম, সেন্ট্রাল পার্ক ট্রেডিং হাউজের মালিক মোহাম্মদ মঞ্জুর আলম, জুপিটার ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মালিক মোহাম্মদ মামুন, চৌধুরী বিজনেস হাউজের মালিক মোহাম্মদ রাসেল চৌধুরী, ডিলাক্সিয়াম ট্রেডিং কর্পোরেশনের মালিক কাজী মেজবাহ উদ্দিন, সোশ্যাল ট্রেড সেন্টারের মালিক আলী জহুর এবং শাহ আমানত ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী চৌধুরী।
দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ইসলামী ব্যাংকের চাকতাই শাখাসহ প্রধান কার্যালয় এবং অন্যান্য ব্যাংক থেকে জব্দ করা রেকর্ডপত্র যাচাই করে দেখা যায়, মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম সারোয়ার চৌধুরী মুরাদ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যাংকের সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে অপকর্ম ঘটিয়েছেন। আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে ২০২১ সালের ২১ থেকে ২৬ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায় ৮৯০ টাকা ঋণ মঞ্জুর করে। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের নভেম্বরে বিনিয়োগ সীমা বৃদ্ধি করে হাজার কোটি এবং ২০২৩ সালের ৭ নভেম্বরে ১১০০ কোটি টাকা মঞ্জুর করা হয়। যার মধ্যে আসল ৯৬৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ও মুনাফা ১২৫.৮০ কোটি টাকাসহ ১ হাজার ৯২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও মানিলন্ডারিং অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে।
পরিবারের ১২৫ ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ
অপরদিকে একইদিনে এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং পরিবারের ৯ সদস্যের ১২৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
দুদকের আরেকটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (১৯ ডিসেম্বর) ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের অবকাশকালীন বিচারক ইব্রাহীম মিয়া এ আদেশ দেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের (এফএসআইবি) বিভিন্ন শাখার।
এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যরা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, পটিয়া, জুবিলী রোড এবং ঢাকার দিলকুশা, কাকরাইল এবং গুলশানের বিভিন্ন শাখায় ২২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৯ হাজার ১৯১ টাকা জমা করেছেন।
এস আলমের পরিবারের অপর সদস্যরা হলেন—ভাই মোহাম্মদ আবদুল্লাহ হাসান, ওসমান গণি, আবদুস সামাদ লাভু, রাশেদুল আলম, শহীদুল আলম, ওসমানের স্ত্রী ফারজানা বেগম, শহীদুলের স্ত্রী, মিসকাত আহমেদ এবং লাভুর স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস।
তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের আদেশ চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক মো. আবু সাঈদ আদালতে আবেদন করেন। তার পক্ষে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম আবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করেন।
আবেদনে দুদক কর্মকর্তা বলেন, এস আলম, তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এবং অন্যান্য দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগের তদন্তের সময় চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ১২৫টি অ্যাকাউন্টে ২২ কোটি ৬৫ লাখ ৪৫ হাজার ১৯১ টাকা জমা থাকার তথ্য পেয়েছেন।
আবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এস আলম ও অন্যদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা প্রয়োজন, যেন তারা টাকা তুলে পাচার করতে না পারে।
বিচারক পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে দুদককে ব্যাংকের ওই শাখাগুলোর পরিচালকদের কাছে আদেশ পাঠানোর নির্দেশও দিয়েছেন।
এর আগে গত ৭ অক্টোবর একই আদালত সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে এক বিলিয়ন ডলার পাচারের অভিযোগে এস আলম, তার স্ত্রী ফারজানা পারভীন এবং তার পরিবারের ১১ সদস্যের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ডিজে