চট্টগ্রামের চকবাজার-রাহাত্তারপুলে নম্বরবিহীন টেম্পোর দৌরাত্ম্যে সড়কে নেমেছে দুর্ভোগ
পুলিশের প্রশ্রয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন কথিত শ্রমিক লীগ নেতা
চট্টগ্রাম নগরীর চকবাজার ও বাকলিয়া থানা এলাকায় ‘চট্টগ্রাম অটোরিকশা-অটোটেম্পু শ্রমিক লীগ’র স্টিকারে ধুনিরপুল থেকে রাহাত্তারপুল পর্যন্ত সড়কে চলছে প্রায় অর্ধশতাধিক অবৈধ টেম্পো। শুধু এসব এলাকায় নয়, অন্যান্য এলাকার রাস্তায়ও চালানো হচ্ছে নিবন্ধনবিহীন অবৈধ টেম্পো। এসব গাড়ির নেই কোনো নম্বর প্লেট ও কাগজপত্র। এছাড়া অধিকাংশ চালকের কাছে নেই ড্রাইভিং লাইসেন্সও। এ বিষয়ে থানা পুলিশ না জানার ভান করলেও বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) বলছে ভিন্ন কথা।
জানা গেছে, ধুনিরপুল থেকে রাহাত্তারপুলের রাস্তাটি বিআরটিএ অনুমোদিত কোনো রুট নয়। ওই এলাকায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতিও নেই। এর আগে সেখানে ব্যাটারিচালিত টমটম চলাচল করত। পরে যানজট ও বিভিন্ন অভিযোগের কারণে এসব বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। এলাকার মানুষ রিকশা কিংবা পায়ে হেঁটে বেশিরভাগ সময় চলাচল করে।
সরেজমিন দেখা গেছে, চলাচল করা প্রায় সকল গাড়ির সামনে ‘রিট পিটিশন (নং-৬৭৫৬/২০২২)-এর পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য হাইকোর্ট কর্তৃক নির্বিঘ্ন ও হস্তক্ষেপমুক্ত চলাচলের আদেশপ্রাপ্ত ইউনিয়ন সদস্যদের থ্রি হুইলার অটোটেম্পু’ লেখা একটি সবুজ রংয়ের স্টিকার লাগানো রয়েছে। এছাড়া কেউ চাঁদা চাইলে ৯৯৯-এ ফোন করার কথা লেখা রয়েছে স্টিকারে।
ধুনীরপুলের নূর বিতান মার্কেটের সামনে রাস্তার একপাশ দখল করে লাইন ধরে রাখা হয়েছে টেম্পোগুলো। ফলে ক্ষণে ক্ষণে যানজট তৈরি হচ্ছে রাস্তার দু’পাশে। মার্কেটে ঢুকতে ক্রেতাদের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। টেম্পো ঘোরানোর সময় লাইনম্যানরা দু’পাশের গাড়ি আটকে রাখে। পরে লাইনম্যানের ইশারায় ধুনীরপুলের ওপর এসে দাঁড়ায় গাড়িগুলো। এরপর যাত্রী ভর্তি করে ছেড়ে যাচ্ছে গন্তব্যে। ওঠানামা ভাড়া জনপ্রতি ১০ টাকা। তবে একটি গাড়িতেও কোনো নম্বর প্লেট দেখা যায়নি। প্রতি গাড়িতে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে নয়জন। দাঁড়িয়েও যাচ্ছেন অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লাইনটি পরিচালনা করেন নজরুল ইসলাম খোকন। আদালতে রিটকারীও তিনি। নিজেকে পরিচয় দেন শ্রমিক লীগ নেতা হিসেবে। অথচ শ্রমিক লীগে তার কোনো পদ-পদবি নেই। তবে ট্রাফিক ও থানা পুলিশের সঙ্গে তার রয়েছে দহরম-মহরম। টাকা ছাড়া তার লাইনে কেউ ঢুকতে পারে না। ঢুকলে উল্টো পুলিশের হয়রানিতে পড়তে হয়।
খোকনের লাইনে টেম্পো চালাতে হলে এককালীন তাকে দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। তবে টাকার পরিমাণ বর্তমানে বেড়ে ৩০-৪০ হাজার হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিন জমা দিতে হয় ১৫০০ টাকা। লাইনে মোট ৩২টি গাড়ি এখন চলাচল করছে প্রতিদিন। এ লাইন নিয়ন্ত্রণ করে তিনি এখন ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য জায়গায়ও তার টেম্পোর লাইন রয়েছে।
আরও জানা গেছে, চকবাজার থেকে রাহাত্তারপুল পর্যন্ত গাড়ির লাইন দেখাশোনা করেন মুন্না, বাদশা, রুবেল-১, রুবেল-২ ও জুয়েল নামের পাঁচজন। তাদের একজনকে দৈনিক ৫০০ টাকা করে বেতন দেওয়া হয়। পরে রাতে তাদের কাছ থেকে লাইনের টাকা বুঝে নেন নজরুল ইসলাম খোকন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ট্রাফিক ও থানা পুলিশ ম্যানেজ করেই চালানো হচ্ছে অবৈধ টেম্পোগুলো। এসব গাড়ি বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। ছোট রাস্তায় ওভারটেকিংয়ের প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে অপ্রাপ্ত বয়স্ক চালকরা। সকাল থেকে গাড়ি চলাচলের বিকট শব্দে স্কুল-কলেজ, মসজিদে প্রাত্যহিক কাজে ব্যাঘাত ঘটে। এছাড়া প্রতিদিন ঘটছে দুর্ঘটনা।
স্থানীয় বাসিন্দারা আরও জানান, গত ৩১ জুলাই ট্রাফিক পুলিশ টেম্পোগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছিল। কিন্তু পরদিন থেকে আবারও চলাচল শুরু করে। এরপর থেকে টানা চলছে বাধাহীনভাবে।
পশ্চিম বাকলিয়ার বাসিন্দা ইব্রাহিম সোহেল বলেন, ‘টেম্পোগুলো বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে রাস্তায়। সম্প্রতি রিকশা করে যাওয়ার সময় পেছন থেকে টেম্পো এসে ধাক্কা দিলে আমি রাস্তায় পড়ে আহত হই। একটি গাড়িতেও কোনো নম্বর প্লেট নেই। একটি স্টিকার লাগিয়ে হাইকোর্টে রিটের কথা বলে গাড়িগুলো চলছে। এ বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর হওয়া উচিত।’
অভিযোগের বিষয়ে নজরুল ইসলাম খোকন বলেন, ‘২০১৬ সালে ১৫০ গাড়ি চলাচলের জন্য আদালতে মামলা করি। সে মামলার রায় আসে ২০২২ সালে। এরপর রাস্তায় আমরা গাড়ি চলানো শুরু করি। বিষয়টি বিআরটিএ, ট্রাফিক পুলিশ ও থানা—সবাইকে জানানো হয়েছে। আদালতের কপিও দেওয়া হয়েছে।’
গাড়ি থেকে এককালীন টাকা আদায়ের বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘লাইনে গাড়ি ঢুকিয়ে টাকা আদায়ের কোনো প্রশ্নই আসে না। কারণ ১৫০ গাড়ির মালিক ও চালকরা সকলেই সমিতির সদস্য এবং এ সমিতি ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত। যিনি এই অভিযোগ করেছেন তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনজুর কাদের মজুমদার বলেন, ‘আসলে আমি এ বিষয়ে অবগত নই।’ পরে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার নেওয়ার আশ্বাস দেন তিনি।
চকবাজার এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘স্টিকার লাগিয়ে গাড়ি চলাচলের বিষয়টি শুধু আমি না, চকবাজার থানার ওসিসহ ট্রাফিকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানেন। তারা হাইকোর্ট থেকে গাড়ি চলাচলের একটি অনুমতি এনেছেন। সে কারণে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না। রিট করে ১৫০ গাড়ি চলাচলের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। তবে গাড়িগুলো কোনরুটে চলাচল করবে সে নির্দেশনা নেই। যার ফলে তারা ওই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিটকারীরা আমাদের ডিসি ট্রাফিক স্যারের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি তাদেরকে ১৫০টি গাড়ি এক রুটে না চালিয়ে ছোট ছোট করে বিভিন্ন রুটে চালানোর মৌখিক একটা নির্দেশনা দিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বিআরটিএর উপ-পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ রকম গাড়ি চালানোর কোনো সুযোগ নেই। সেখানে ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে অভিযান পরিচালনা করে গাড়িগুলো ডাম্পিংয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’
সিপি