জহুর-মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঠাঁই হল না ৩১ ‘চট্টল গৌরবে’র তালিকায়ও

4

চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান ওয়ার্ডে ৩১ বরেণ্য ব্যক্তির ছবি সম্বলিত ম্যুরাল নির্মাণ করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন। ‘চট্টল গৌরব’ নামের ওই ম্যুরালে ভারতের হুগলীতে জন্ম নেওয়া হাজী মুহাম্মদ মহসীনের জায়গা হলেও ঠাঁই হয়নি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচিত মেয়র কিংবদন্তী জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর। এই তালিকায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে অনেকে বলছেন ৩১ বরেণ্য চট্টল গৌরবের তালিকায়ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্থান না পাওয়াটা ‘হীন রাজনীতি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। এক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মানসিকতা একটা বড় সমস্যা বলে ধারণা তাদের।

বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সৈনিক ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জহুর আহমদ চৌধুরীর নাম চট্টলগৌরবের তালিকায় নেই। চট্টগ্রামকে সারা বিশ্বে পরিচিত করিয়েছেন যিনি, সেই এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদকারী বরেণ্য রাজনীতিবিদ মৌলভী সৈয়দও নেই। এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে বাদ দিয়ে বরেণ্য ব্যক্তির তালিকা কিভাবে হয়? শত বছরের রাজনৈতিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এদের বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। চট্টগ্রামের এরা ভূমিপুত্র। অথচ চট্টগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন কেউ কেউও ম্যুরালে স্থান পেয়েছেন।’

ম্যুরালের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটির মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। প্রধান অতিথি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।
ম্যুরালের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটির মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। প্রধান অতিথি নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন।

তবে এই উদ্যোগটির উদ্যোক্তারা বলছেন, অনেক বরেণ্য ব্যক্তি চট্টগ্রামে রয়েছেন যাদের অনেককেই ছবিতে আনা যায়নি। এক্ষেত্রে শুধু অর্জন নয় বরং অর্জনের পাশাপাশি তাদের অবদান রাখার সময়কালকেও গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। এই কারণেই ৩১ জনের তালিকায় নেই এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পরবর্তীতে আরও ৯ জনের ছবি এই তালিকায় যুক্ত হবে সেখানে অনেকের ছবিই আসবে।

বৃহস্পতিবার (১৬ ডিসেম্বর) রাত ৮টায় চট্টগ্রাম হাজী মুহাম্মদ মহসীন হাই স্কুলের দেয়ালে নবনির্মিত ম্যুরালের উদ্বোধন করেন চট্টগ্রাম সিটির মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চসিক সাবেক মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন কবি ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন, দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এমএ মালেক, আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক চন্দন ধর, জামালখান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসেম বাবুল, দৈনিক আজাদী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ওয়াহেদ মালেক, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মিঠুন বড়ুয়া, চসিক সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর রুমকি সেনগুপ্ত, শায়লা আক্তার রুজি প্রমুখ।

পরিকল্পনায় শৈবাল দাশ সুমন। সহায়তায় নুর মোস্তফা টিনু ও রুমকি সেনগুপ্ত।
পরিকল্পনায় শৈবাল দাশ সুমন। সহায়তায় নুর মোস্তফা টিনু ও রুমকি সেনগুপ্ত।

যে ৩১ জনের ম্যুরাল উন্মোচিত হয়েছে তারা হলেন— দানবীর হাজী মুহম্মদ মহসিন, মুহম্মদ এনামুল হক, আবুল কাশেম খান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মোজাফফর আহমদ, বিনোদ বিহারী চৌধুরী, কাজেম আলী মাস্টার, মাহবুব উল আলম, কল্পনা দত্ত, মাহাবুব উল আলম চৌধুরী, শেখ রফিউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী, শরৎ চন্দ্র দাস, বুলবুল চৌধুরী, চাকমা রাণী কালীন্দী, লোকনাথ বল, বেনীমাধব বড়ুয়া, আব্দুল হক দোভাষ, এম এ আজিজ, নবীনচন্দ্র সেন, অমলেন্দু বিশ্বাস, এম এ হান্নান, কবিয়াল রমেশ শীল, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, রজব আলী খান, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, নবীন চন্দ্র সেন, কবি আব্দুল হাকিম, আবদুল করিম, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অধ্যাপক আবুল ফজল ও যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত।

কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন জানান, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, প্রফেসর ড. অনুপম সেন, অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত এবং কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেনের সমন্বয়ে একটি জুরি বোর্ড ১০০ জন মনীষী থেকে ৪০ জনকে বাছাই করেন। পরে শিল্পী প্রণব কুমার সরকার এ ম্যুরালগুলো নির্মাণ করেন। সেখান থেকে ৩১ জনকে নিয়ে ‘চট্টল গৌরব’ শিরোনামে ম্যূরাল উন্মোচিত হয় ১৬ ডিসেম্বর। এই প্রকল্পে অর্থায়ন করে চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান ফোর-এইচ গ্রুপ।

চট্টগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন কেউ কেউও ম্যুরালে স্থান পেয়েছেন ‘চট্টল গৌরব’ হিসেবে।
চট্টগ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, এমন কেউ কেউও ম্যুরালে স্থান পেয়েছেন ‘চট্টল গৌরব’ হিসেবে।

কী বিবেচনায় এই ম্যুরালে জায়গা পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকা করা হয়েছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তালিকা প্রস্তুত করার প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকা একুশে পদক পাওয়া কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি সব সেক্টর থেকেই গুণি ব্যক্তিদের এখানে রাখার। তবে উদ্যোগটা বাস্তবায়ন করেছেন শৈবাল দাশ সুমন। আপনারা এটি নিয়ে তার সাথেই কথা বলুন।’

তবে ৩১ জনের তালিকাতেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম না থাকার ক্ষেত্রে নিজের কোনো দায় নেই জানিয়ে শৈবাল দাশ সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি শুধু উদ্যোগটা নিয়েছি আর বাস্তবায়ন করেছি। এখানে কার ছবি থাকবে কার ছবি থাকবে না এখানে আসলে আমার কোনো ভূমিকা নাই। আমাদের শহরের চারজন গুণি ব্যক্তি এই তালিকাটা করেছেন।’

এই ম্যুরালে কারও নাম থাকা না থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিকতা নেই জানিয়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের এই কাউন্সিলর বলেন, ‘উনারা ৪০ জনের একটা তালিকা করেছেন। সেখানে ৯ জনের ছবি এখনো আমরা বসাতে পারিনি। সুতরাং যাদের ছবি এখনও আসেনি তাদের ছবি সামনে আসবে না এমনটা বলার তো সুযোগ নাই। আমরা অর্জন বা ভূমিকার পাশাপাশি উনাদের বয়সের টাইমফ্রেমটাকেও গুরুত্ব দিয়েছি। বয়স অনুযায়ী বা কাজের সময়কাল অনুযায়ী এই তালিকা আমরা করেছি।’

তবে মহিউদ্দিন চৌধুরীর জায়গা না হলেও চট্টগ্রামে জন্ম না নেওয়া বা কখনও চট্টগ্রামে পদধূলি না দেওয়া হাজী মুহাম্মদ মহসিনের ছবিও আছে ‘চট্টলগৌরব’ নামের ওই ম্যুরালে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে শৈবাল দাশ সুমন বলেন, ‘যেহেতু উনার নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুলের দেয়ালে এই ম্যুরাল করা হয়েছে, তাই চট্টগ্রামের সাথে সম্পর্ক না থাকলেও উনাকে এইখানে রেখেছি আমরা।’

তবে শৈবাল দাশ সুমনের এসব যুক্তিকে খোঁড়া যুক্তি বলেই মনে করছেন মহসীন কলেজের শিক্ষার্থী আনোয়ার পলাশ। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘উনার (হাজী মহসিন) নামের স্কুল বলেই উনাকে চট্টলগৌরব বলা হবে এটা কোনো যুক্তি হতে পারে? চট্টল গৌরবের তাহলে অর্থ কী? তাছাড়া অর্জনের মূল্যায়ন টাইমফ্রেম দিয়ে হয় এটাও তো জানা ছিল না। চট্টল গৌরব শিরোনামে করা একটা ম্যুরালে ৩১ জনের তালিকাতেও মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম থাকবে না এটা কে মেনে নিতে পারে? এটা মূলত আয়োজকদের মনন ও মানসিকতার সমস্যা।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শুক্রবার জামালখানের ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় বিষয়টি আমি খেয়াল করি। তখনই জহুর আহমদ চৌধুরীর পুত্র চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীকে ফোন করে বিষয়টা অবহিত করেছি।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য বলেন, ‘যারা এই কাজটা করেছেন, তারা যেন আবার চিন্তা করে ঢেলে সাজায়— এই প্রত্যাশা থাকবে আমার।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

4 মন্তব্য
  1. শাহাদাত হোসেন চৌধুরী রুমেল বলেছেন

    সাবেক উপাচার্য মহোদয়ের সাথে একমত। মহিউদ্দিন চৌধুরী হলো চট্টগ্রামের অহংকার, চট্টলবীর কে বাদ দিয়ে সম্মাণিত হতে পারে না কেউ।

  2. সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার বলেছেন

    হাজী মুহাম্মদ মুহসিন এর নামে স্কুল এর দেয়ালে স্হাপিত হয়েছে বলে তিনি কীর্তিমান হয়ে গেলেন এমন খোড়া যুক্তি দিয়ে চট্টগ্রাম এর একজন বীর সন্তান এ,বি, এম মহিউদ্দীন চৌধুরী স্হান না পাওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক।

    1. মাহবুব বলেছেন

      এটা দুঃসাহস!!!
      শৈবাল দাশ সুমনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্ৰহণ করা হোক এবং তাকে কাউন্সিলর পদে থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।

  3. ইকবাল হোসেন বলেছেন

    সম্পূর্ণ হাস্যকর কিছু মন্তব্য।

    মাহবুবু সাহেব, কোন ক্ষমতা আর আইনে শৈবাল দাস সুমনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিবে এবং কাউন্সিলর পদ থেকে অব্যাহতি দেবে?

    চট্টগ্রামের চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মাধ্যমে ৪০জন চট্টল বীরের তালিকা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ জনের ম্যুরাল স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ৯জনের ম্যুরাল জায়গা সংকুলানের জন্য স্থাপন করা যায়নি। তারা তো অস্বীকার করেনি, বাকি ৯ জনের মধ্যে দুই চট্টলবীর জহুর আহমদ চৌধুরী ও মহিউদ্দিন চৌধুরী নেই। আবার এটাও অস্বীকার করেনি, সেগুলো স্থাপন করা হবে না। তারা তাদের বক্তব্যে বলেছেন, খুব শিগগির পরবর্তী দেওয়ালে বাকিগুলোও স্থাপন করা হবে।

    শাহাদাত হোসেন চৌধুরী রুমেল সাহেব, হাজী মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরী বাদে বাকি ৩০জন ব্যক্তি কি চট্টগ্রামের অহংকার নয়? মহিউদ্দিন চৌধুরী কি তাদের চেয়েও বড় কেউ ছিলেন? চট্টগ্রামের জন্য তাদের দান-অবদান-ভূমিকা কি মহিউদ্দিন চৌধুরী থেকে কম? কেন আগে তাকেই সম্মানিত করে অন্যদের সম্মানিত করতে হবে?

    সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার সাহেব, যুক্তিটা শতভাগ ঠিক না হলেও পুরোপুরি ভুলও কিছু নয়।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm