পুলিশের আদরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা অপরাধীচক্রের বাড়বাড়ন্ত
এক টিআই আড়াই মাস ক্লোজড ছিলেন মাদকসেবনের অপরাধে
কক্সবাজারে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে ওঠছে রোহিঙ্গা অপরাধী সিন্ডিকেট। মাদক ব্যবসা, নারীদের দিয়ে অনৈতিক কাজ, পরিবহন থেকে চাঁদা আদায়—সব ধরনের অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে সিন্ডিকেটের লোকজন। এসব অপরাধের নেপথ্যে কক্সবাজার ট্রাফিক পুলিশের এক ইন্সপেক্টর (টিআই) জড়িত আছেন বলে অভিযোগ ওঠেছে। এই সিন্ডিকেটে তার সহযোগী হিসেবে রয়েছেন মনসুর, আব্দুছ সালাম ও সেলিম নামের তিন রোহিঙ্গা যুবক। এই চারজনের সিন্ডিকেট দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকা।
এছাড়া এই সিন্ডিকেটের সাতটি গাড়িতে করে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে মাদকপাচারেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এসব কিছুর পেছনে নাটের গুরু সেই টিআই আমিনুর রহমান।
জানা গেছে, সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মনসুরের সঙ্গে টিআই আমিনুর রহমানের পরিচয় হয় কাগজপত্রবিহীন একটি পাজেরো গাড়ি আটকের ঘটনায়। এক বছর আগে কলাতলীতে মনসুরের গাড়ি আটক করেন টিআই আমিনুর। পরে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গাড়িটি ছাড়িয়ে নেন মনসুর।
একপর্যায়ে টিআই আমিনুরকে দাওয়াত দিয়ে মদ, নারীর জলসাতে নিয়ে যান মনসুর। তখন থেকেই দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত হয়। মনসুরের মাদক ব্যবসায় সঙ্গ দিয়ে এক বছরে পাঁচটি গাড়ির মালিক হন টিআই আমিনুর। গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে একটি মোটরসাইকেল, একটি নোহা, একটি পাজেরো, একটি ল্যান্ডক্রুজার ও একটি জিপ। বর্তমানে সবকটি গাড়ি পুলিশের লোগো ও স্টিকার লাগিয়ে চালাচ্ছেন মনসুর, আব্দুছ সালাম ও সেলিম। সেইসঙ্গে নিরাপদে চালছে ইয়াবা ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম।
আরও জানা গেছে, মনসুরের বাড়ি মিয়ানমারের বুচিদং। তার বাবা জাফর আমির হোছন ও মা দলু বিবি অনেক আগে অবৈধভাবে এদেশে এসে টেকনাফের নতুন পল্লানপাড়ায় আশ্রয় নেন। কৌশলে ভুয়া কাগজ তৈরি করে বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়ে সপরিবারে দুবাই পাড়ি জমান তারা। জাফরের দুই ছেলে মনসুর ও ওমর। মাদকসেবন করে কলেজছাত্রী অপহরণের ঘটনায় দুবাইয়ে মনসুরের তিন বছর এবং ওমরের দু’বছর সাজা হয়।
সাজা শেষে বিদেশ থেকে তাদের ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দেশে এসে প্রথমে টেকনাফ, পরে কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ হাজীপাড়ায় বসবাস শুরু করেন তারা। ওই বছরই মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায় সেই দেশের সেনাবাহিনী। ফলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা এই দেশে প্রবেশ করে। আর তাদের নিয়ে মানবতার কাজ শুরু করে দেশি-বিদেশি এনজিও সংস্থা। ওই সময় মিয়ানমার, ইংরেজি ও আরবি ভাষা জানার সুবাদে ‘হেলভেটাস’ নামের একটি এনজিওতে চাকরি পান মনসুর। কয়েক মাস চাকরি করতে না করতেই মনসুরের হাতে ধরা দেয় ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা। টাকার নেশায় অল্প সময়েই ইয়াবার ব্যবসা করে রাতারাতি কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যান তিনি।
এরপর কক্সবাজার সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউপির দক্ষিণ হাজীপাড়ার ঠিকানায় মনসুর ও ওমর বানিয়ে নেন জাতীয় পরিচয়পত্র। একইসঙ্গে ৫৫ লাখ টাকায় কিনে নেন রেডিমেইড দোতলা বাড়ি। কিনেন পাজেরো, মোটরসাইকেলও। শহরের জেলগেট এলাকায় কয়েকটি দোকানও রয়েছে তার। তবে মনসুর ও তার ভাই ওমরের জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেও তাদের বাবা-মা এবং দাদার নেই।
সিন্ডিকেটের আরেক সহযোগী মিয়ানমারের নাগরিক সেলিম বলেন, ‘এখন আমি তাদের সঙ্গে নেই। আমি উপজেলায় একটা দোকান করতাম। তারা রাতের বেলায় মদ ও নারী নিয়ে আমার দোকানে আসর বসাতো। যার কারণে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি, দোকানও নিয়ে গেছে মালিক। তাই দয়া করে তাদের অপকর্মে আমাকে জড়াবেন না।’
তবে মনসুর বলেন, ‘আমি রোহিঙ্গা নই। আমার বাড়ি প্রথমে টেকনাফ, পরে শহরের বাদশাঘোনা ছিল। এরপর পিটি স্কুল এবং বর্তমানে উপজেলার হাজীপাড়ায়। আমার বাপ-দাদা ও মাসহ সবাই বিদেশ থাকায় ভোটার হতে পারেননি, আমরা দু’ভাই হয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘টিআই আমিনের সঙ্গে আমার গাড়ি আটকের ঘটনা নিয়ে সম্পর্ক হয়েছে, তা সত্য। তার পাঁচ-ছয়টি গাড়ি পড়ে আছে। সেগুলো নানা কাজেকর্মে তার অনুমতি নিয়ে চালাই। গাড়িতে পুলিশের স্টিকার লাগানো আছে, সেখানেতো আমার করার কিছুই নেই। এই গাড়ি করে ইয়াবা পাচারের বিষয় সত্য নয়। তবে মাঝে মধ্যে এনজিওতে কর্মরত সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধব চলাচল করেন।’
ট্রাফিক বিভাগ সূত্র জানা গেছে, চার-পাঁচ মাস আগে টিআই আমিনের বিরুদ্ধে মাদকসেবন, নারীদের নিয়ে জলসা, রোডে যানবাহন ও পরিবহন থেকে চাঁদাবাজির কারণে সাবেক পুলিশ সুপার হাসানুজ্জামান তাকে আড়াই মাস ক্লোজ করে অফিসে বসিয়ে রেখেছিলেন। পরে অনেক কাকুতি-মিনতির পর আবার ডিউটি পান তিনি।
ক্লোজড করার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগের টিআই আমিনুর রহমান বলেন, ‘আমাকে ক্লোজড করে অফিসে বসিয়ে রাখা পুলিশের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’
বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মনসুরের সঙ্গে আমার গাড়ি আটকের ঘটনায় সম্পর্ক হয়, তা ঠিক। তবে অবৈধ কোনো কিছু করি না। সারাদিন কাজ শেষে রাতে একটু আড্ডা দিই। আমার পাঁচটি গাড়ি আছে, এসব বিক্রি করার জন্য কিনেছি। গাড়িগুলো পড়ে আছে বিধায় মনসুরসহ কয়েকজন চালায়। গাড়িতে পুলিশের লোগো ও স্টিকার ছিল, সব খুলে ফেলেছি। মনসুরসহ তারা কয়েকজন আমার গাড়ি চালাচ্ছে চার-পাঁচ মাস হবে।’
কক্সবাজার ট্রাফিক বিভাগের ইনচার্জ আমজাদ হোসেন বলেন, ‘তার (টিআই আমিনুর) বিষয়ে আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার সবকিছু এই শহরের সবাই জানে। একটা মানুষের ভালো খারাপের সাইট কয়টা থাকে আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। দয়া করে আপনি সিনিয়র অফিসারের সঙ্গে কথা বলেন।’
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশের লোগো বা স্টিকার লাগিয়ে সাধারণ লোকজন গাড়ি ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। করে থাকলে এটি আইনত অপরাধ। টিআই হিসেবে তার ব্যবহারের জন্য সর্বোচ্চ একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে পুলিশের স্টিকার লাগিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। আমি এখনই খোঁজখবর নিচ্ছি। যদি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ডিজে