চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় তানভীর হোসেন তুর্কি নামে এক যুবককে ‘অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানো’র ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পুলিশকে দায়মুক্তি দেওয়ার অপচেষ্টার অভিযোগ উঠেছে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বিরুদ্ধে। বাদির অভিযোগ, অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর তথ্য-প্রমাণ থাকলেও পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা অভিযুক্ত পুলিশদের রক্ষার উদ্দেশ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও আমাদের ন্যায় বিচার প্রাপ্তিকে বাঁধাগ্রস্থ করবে।
পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদন প্রত্যাখান করে আদালতের কাছে বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছে ভুক্তভোগীর পরিবার।
বাদি রাহাত হোসেন কফিল দাবি করেন, পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা বাবুল আকতার তদন্তে আমাদের কাছ থেকে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেননি। সাক্ষীর জবানবন্দির বিষয়টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে গত ৩ নভেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। বাদি হিসেবে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কেও আমাকে অবগত করা হয়নি। আমি বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তিনি সাড়া দেননি।
তিনি আরও দাবি করেন, বাবুল আকতার আসামিদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন অনৈতিক সুবিধা আদায়ের মাধ্যমে। তাদের দায়মুক্তির জন্য ভুলভাল তথ্য উপস্থাপন করে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে দাখিল করেছেন। এমনকি এসআই রেজাউলের কল রেকর্ডও বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে। এতে আমরা ন্যায় বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে বাধাগ্রস্ত। তাই পিবিআইয়ের পক্ষপাতমূলক প্রতিবেদন আমরা প্রত্যাখান করছি। দাবি করছি বিচার বিভাগীয় তদন্তের। এতে ঘটনার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কফিল আরও জানান, ঘটনাস্থলে পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা আসলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা সেদিনের ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তারা স্পষ্টভাবে জানান ওইদিন তুর্কি সহপাঠীদের নিয়ে মাঠে ক্রিকেট খেলছিল। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা সাদা পোশাকে এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। এসময় কোনো অস্ত্র বা গোলাবারুদ পাওয়া যায়নি। পুলিশ পরে তুর্কিকে অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার দেখিয়ে আদালতে চালান করেন, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ। কয়েকজন সাক্ষী পিবিআই কার্যালয়ে গিয়েও সাক্ষ্য দিয়ে এসেছেন। কিন্ত তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে ওইসবের কিছুই উল্লেখ করেননি। এসবের ভিডিও সংরক্ষণ আছে আমাদের কাছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, সম্প্রতি তদন্ত কর্মকর্তা বাবুল আকতারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে, তিনি আমাকে সাফ জানিয়ে দেন, যেহেতু আপনার ভাইয়ের বিরুদ্ধে পুলিশের দায়ের করা অস্ত্র আইনে মামলা চলমান, সেহেতু তদন্তে তুর্কিকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এজন্য আদালতের নির্দেশনা লাগবে।
এ বিষয়ে জানতে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক মো. বাবুল আকতারের মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
পিবিআই চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রুহুল কবীর খান বলেন, বিষয়টি আমার স্মরণে নেই। আমি কয়েকদিন ছুটিতে ছিলাম। খোঁজ নিয়ে প্রকৃত কারণ জানাতে পারব।
২০২৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সাতকানিয়ার ঢেমশা ইউনিয়নের মাইজপাড়া এলাকায় মাঠে ক্রিকেট খেলছিল একদল যুবক। সেখান থেকে সাদা পোশাকধারী একদল পুলিশ তুর্কিকে আটক করে বিলের মাঝে নিয়ে যেতে থাকে। এ সময় স্থানীয় এলাকাবাসী এগিয়ে এলে পুলিশ ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে। পুলিশ তুর্কিকে থানায় নিয়ে গেলে তার ছোট ভাই হিরু হোসেন খোঁজ নিতে যান। তাকেও আটক করে রাখা হয় থানায়। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে ছেড়ে দেওয়া হয় হিরুকে। পরেরদিন থানা থেকে তুর্কিকে আদালতে নেওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠানো হলেও আবার নামিয়ে নিয়ে নির্যাতন করা হয় অদৃশ্য শক্তির চাপে। এ ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী যুবকের বড় ভাই রাহাত হোসেন। এ নিয়ে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলনও করা হয়। পুরো ঘটনা প্রকাশ পেলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে পুলিশ প্রশাসন।
সাংবাদিক সম্মেলনে তুর্কির ভাই রাহাত হোসেন কফিল দাবি করেন, আটকের পর থানায় নিয়ে তুর্কিকে নির্যাতন করেছে পুলিশ। তুর্কি স্থানীয় রাজনীতিতে সাবেক সংসদ সদস্য আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর অনুসারী। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তার পক্ষে কাজ করেন। তিনি নির্বাচনে হেরে গেলে বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএ মোতালেবের অনুসারীরা নানাভাবে তুর্কিকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় পুলিশ দিয়ে আটক করিয়ে অস্ত্র মামলায় ফাঁসিয়েছে। তুর্কিকে পুলিশের গাড়িতে তোলার সময়ও সুস্থ-স্বাভাবিক ছিল। পরে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আবার থানায় ঢোকানো হয়। দেড় ঘণ্টা পর আদালতে নেওয়ার জন্য বের করা হলে মুখ বিকৃত ও নির্যাতনের আলামত দেখা যায়। সারা শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন। তুর্কিকে থানায় আটকের পর বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল।
তুর্কির ভাই কফিলের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্তরা হলেন—সাতকানিয়া থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) আতাউল হক চৌধুরী, এসআই আবদুর রহিম, মোস্তাক আহমেদ, এএসআই রেজাউল করিম, ইকবাল হোসেন, জহিরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন অনিক ও কনস্টেবল কবির হোসাইনকে। আদালত বাদির বক্তব্য গ্রহণ করে সাতকানিয়া সার্কেলে সহকারী পুলিশ সুপারকে (এএসপি) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
মামলার তদন্তভার পাওয়া সাতকানিয়া সার্কেলের এএসপির সেই রিপোর্টের বিপরীতে আদালতে নারাজি দেন বাদি। আদালত ওই মামলা পুনঃতদন্তের জন্য দেয় পিবিআইকে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তুর্কিরা যে ওই মাঠে সবাই ক্রিকেট খেলছিলেন, তা ফেসবুকে লাইভ করেন মো. এনামুল নামে একজন। পরে অজ্ঞাত পরিচয়ের এক ব্যক্তি মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে তাকে দিয়ে ভিডিওটি মুছে ফেলেন।


