আরাফার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে লাখো মানুষের জমায়েত যেন হাশরের ময়দানের এক জীবন্ত ঝলক। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে সেখানে হাজিরা দাঁড়িয়ে থাকেন আল্লাহর রহমতের আশায় এবং শাস্তির ভয়ে—একইসঙ্গে আশা ও ভয়ের এক করুণ দৃশ্য তৈরি হয়। হজের প্রতিটি আমল হাজিদের মনে পরকালীন জীবনের স্মরণ জাগিয়ে তোলে।
হজের সূচনাতেই একজন হজযাত্রী নিজেকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন। মুখে উচ্চারিত হয়—“লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারীকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়ালমুল্ক, লা শারীকালাক।”
জিলহজ হলো চারটি সম্মানিত মাসের একটি। এর প্রথম দশ দিন অত্যন্ত মর্যাদাসম্পন্ন। পবিত্র কোরআনে সূরা ফজরের শুরুতেই বলা হয়েছে: “শপথ ফজরের, শপথ দশ রাত্রির।” এই আয়াত জিলহজের দশ রাতের গুরুত্ব প্রতিফলিত করে।
হজ আরবি শব্দ, যার অর্থ সংকল্প বা ইচ্ছা। ইসলামী পরিভাষায়, নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে আল্লাহর আদেশ পালন করাই হজ। এটি ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানের জীবনে একবার হজ করা ফরজ।
হজের বহুমাত্রিক তাৎপর্য
১. আল্লাহর আদেশ পালন:
হজ আদায়ের মাধ্যমে একজন মুসলমান আল্লাহর ফরজ আদেশ পালন করে থাকেন। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পালন করে না, তার মৃত্যু ইহুদি বা নাসারার মতো হতে পারে।
২. আধ্যাত্মিক শক্তির উন্মেষ:
হজ শুধু একটি ইবাদত নয়, বরং এটি মুসলিম উম্মাহর জন্য আধ্যাত্মিক জাগরণের এক বিশাল প্ল্যাটফর্ম। হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র.) বলেছেন, হজ হচ্ছে ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর আত্মত্যাগের উত্তরাধিকার রক্ষার প্রতীক।
৩. বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন:
হজ একটি বৈশ্বিক মুসলিম মিলনমেলা, যেখানে সব জাতি-গোষ্ঠীর মুসলিম একত্রিত হন। ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতির ভেদাভেদ ভুলে সবাই কাবার দিকে ধাবিত হন এবং এক কণ্ঠে উচ্চারণ করেন লাব্বাইক।
৪. আর্থিক কল্যাণ:
হজে ব্যয় করলে দারিদ্র্য আসে না, বরং তা সমৃদ্ধির পথ খুলে দেয়। বহু হাদিসে এসেছে, হজ-ওমরাহ অর্থনৈতিক কল্যাণও বয়ে আনে।
৫. নিরাপত্তা ও বিশুদ্ধতা:
হজ মানুষকে পাপমুক্ত করে। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি খাঁটি মনে হজ করে, সে পাপমুক্ত হয়ে ফিরে আসে, যেমন মায়ের গর্ভ থেকে সদ্য জন্ম নেয়া শিশু।
৬. ত্যাগ ও কোরবানির শিক্ষা:
ইব্রাহিম (আ.)-এর পরিবার যেমন আল্লাহর পথে আত্মত্যাগ করেছে, হজও হাজিদেরকে সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৭. বিশ্বভ্রাতৃত্বের চেতনা:
আরাফার ময়দানে দাঁড়িয়ে লক্ষ মুসলমান যখন একসাথে দোয়া করে, তা মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের অনন্য নিদর্শন হয়ে ওঠে।
৮. প্রশস্ত হৃদয়ের পরিচয়:
দেশের গণ্ডি পেরিয়ে নানা দেশের মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে হজ পালন করলে মানুষের হৃদয় হয় উদার ও প্রশস্ত।
৯. আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত লাভ:
আরাফার দিনে আল্লাহ তাআলা আসমানে এসে ফেরেশতাদের উদ্দেশে বলেন, “দেখো আমার বান্দাদের, তারা ধুলায় মলিন, এলোমেলো অবস্থায় এসেছে শুধু আমার সন্তুষ্টির আশায়।”
উপসংহার
হজ এমন এক ইবাদত যা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং জাতিগত ও বৈশ্বিক কল্যাণের পথ তৈরি করে। এটি মুসলিম উম্মাহকে নতুন করে জাগ্রত করে, আত্মশুদ্ধির দ্বার খুলে দেয় এবং আখিরাতের জন্য এক অপূর্ব প্রস্তুতি। হজ সত্যিকার অর্থেই দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা লাভের সেতুবন্ধন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট