চট্টগ্রামে ‘মানিলন্ডারিং’ ঝড়ে ১৪৫ নেতার নাম, মন্ত্রী-এমপির সঙ্গে কুকিচিন ও ইসকন নেতাও
মৃত কাউন্সিলরের নামও তালিকায়
চট্টগ্রামে রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী মহলের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এক বিস্তৃত অনুসন্ধান প্রস্তাব প্রকাশিত হয়েছে, যা নগরের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে নতুন আলোড়ন তৈরি করেছে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র, কাউন্সিলর, ব্যবসায়ী, কুকিচিন ‘লিয়াজোঁকারী’, ইসকন নেতা এবং আওয়ামী লীগ-যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাসহ ১৪৫ জনের নাম মানিলন্ডারিং আইনে (অবৈধ অর্থ লেনদেন) অনুসন্ধানের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এই তালিকায় অভিযুক্তদের রাজনৈতিক ও পেশাগত পরিচয়, মামলা সংখ্যা, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর এবং অপরাধের ধরন বিস্তারিতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তালিকায় অনেক সাবেক মন্ত্রী ও এমপির নাম বাদ পড়ায় বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে রহস্যময়তার সৃষ্টি করেছে।
জানা গেছে, চলতি অক্টোবরের শুরুতে চট্টগ্রাম নগরের দামপাড়া সিএমপি হেডকোয়ার্টারে এই সংক্রান্ত মামলাগুলো নিয়ে বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়, যাতে সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস)। সভায় সিএমপির বিভিন্ন থানার সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সিএমপি সূত্র জানায়, সভায় সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত মামলার তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য স্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়। বিষয়টি সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজের পক্ষে নিশ্চিত করেছেন সহকারী পুলিশ কমিশনার নুরুল ইসলাম সিদ্দিক।
তথ্য অনুযায়ী, ২৮ মে থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাস ১৩ দিনের অনুসন্ধানে ১৪৬ জনের নামের তালিকা প্রস্তুত করা হয়। একাধিক ক্ষেত্রে একজনের নাম দুইবার অন্তর্ভুক্ত থাকায় চূড়ান্ত সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৫ জনে। তালিকায় বেশিরভাগ অভিযুক্তকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া এমন ব্যক্তিও রয়েছেন, যিনি গত চার বছর আগে মারা গেছেন, তবে তার নাম এখনও তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেক সোলেমান সেলিম ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি মারা যান। অন্যদিকে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজের নাম তালিকায় দুইবার আছে; একবার ৫৭ নম্বর ক্রমিকে এবং একবার ১১৪ নম্বর ক্রমিকে।
সিএমপি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় মামলার সংখ্যা ভিন্ন; কারো নামে ১৫টি, কারো নামে ২০টি, কারো নামে ১১টি এবং কারো নামে ৬–৭টি মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে অনেকের বিরুদ্ধে মামলা না থাকলেও তারা অভিযুক্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত। এসব মামলা সাধারণত ২০২৪ ও ২০২৫ সালে সিএমপির বিভিন্ন থানায় নথিভুক্ত হয়েছে।
অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছে কোতোয়ালী, চাঁন্দগাও, ডবলমুরিং, হালিশহর, বায়েজিদ, পাঁচলাইশ, বন্দর, বাকলিয়া, ইপিজেড, পতেঙ্গা সদরঘাট ও পাহাড়তলী থানার মামলায় যুক্ত ব্যক্তিরা।
প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে তালিকাভুক্ত হয়েছেন সাবেক শিক্ষা মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক এমপি এমএ লতিফ, সাবেক এমপি আবু রেজা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন নদভী, সাবেক এমপি দিদারুল আলম দিদার, সাবেক এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, সাবেক এমপি মহি উদ্দিন বাচ্চু, সাবেক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সাবেক কাউন্সিলরদের মধ্যে রয়েছেন শৈবাল দাশ সুমন, হাসান মুরাদ বিপ্লব, পুলক খাস্তগীর, চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, মোহাম্মদ ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, আবুল হাসনাত বেলাল, আবদুল বারেক, গোলাম মোহাম্মদ জোবায়ের, মোহাম্মদ আব্দুল কাদের প্রকাশ মাছ কাদের, আতাউল্লাহ চৌধুরী, মোরশেদ আলম, মোবারক আলী, আব্দুস সবুর লিটন, সাবের আহাম্মদ সওদাগর, নাজমুল হক ডিউক, মোহাম্মদ জাবেদ, নজরুল ইসলাম বাহাদুর, সাবেক মহিলা কাউন্সিলর রেখা আলম চৌধুরী, সাবেক কাউন্সিলর ইসমাইল হোসেন, নুর মোস্তফা টিনু, কাজী নুরুল আমিন মামুন, আশরাফুল আলম, মোহাম্মদ হোসেন হিরণ, হারুন অর রশীদ, নুরুল আলম মিয়া, মোহাম্মদ ইসহাক।
তালিকায় রয়েছেন—সাবেক মহিলা কাউন্সিলর জেসমিন খানম, আফরোজা জহুর, জোবাইরা নার্গিস খান, আঞ্জুমান আরা, শাহিন আক্তার রোজী, ফেরদৌস বেগম মুন্নী, জেসমিন পারভীন জেসি, মনোয়ারা বেগম মনি, সৈয়দা কাশফিয়া নাহরীন, তসলিমা বেগম প্রকাশ নুর জাহান, শাহিনুর বেগম, নীলু নাগ, লুৎফুন্নেছা দোভাষ, রুমকি সেন গুপ্ত, এইচএম এরশাদ উল্লাহ, এইচএম সোহেল, ফারহানা জাবেদ, ফেরদৌসি আকবর, নিছার উদ্দিন আহমেদ, জিয়াউল হক সুমন, শহিদুল আলম, এসরারুল হক, নুরুল আলম, গিয়াস উদ্দিন, আবুল ফজল কবির আহম্মেদ, কফিল উদ্দিন খান, শাহেদ ইকবাল বাবু, গাজী মোহাম্মদ শফিউল আজিম, হাজী জয়নুল আবেদীন, সালেহ আহম্মদ চৌধুরী, সলিম উল্লাহ বাচ্চু, আব্দুল মন্নান, মোরশেদ আলী, গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, তৌফিক আহম্মদ চৌধুরী, জহুর লাল হাজারী ও মরহুম তারেক সোলায়মান।
কুকিচিন লিয়াজোঁকারী নিয়াজ হায়দার ও কুকিচিন প্রতিনিধি মং হ্লাচিং মারমার রয়েছে তালিকায়। এছাড়া আছে ইসকন নেতা লক্ষণ কান্তি দাশ প্রকাশ লীলারাজের নামও।
আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে রয়েছেন হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর, দেবাশীষ পাল দেবু, আব্দুন নবী প্রকাশ লেদু হাজী, মুসা আলম, মো. সাবিউল আরমান, সাহিদুল ইসলাম আলম সিকদার, যুবলীগ নেতা আবুল বশর, আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান, মোহাম্মদ শাহেদ, মো. কামরুজ্জামান, এম এ মোতালেব, আসিফ খান, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানুল করিম, সৈয়দ মাহমুদুল হক, সিএন্ডএফ ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা আলতাফ হোসেন বাচ্চু, আব্দুল মালেক প্রকাশ বাবুল, মো. ইদ্রিস, মহেশখালী কালামারছাড়ার সাবেক চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা তারেক বিন ওসমান শরীফ, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ফারুক চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা ভিপি তাহসীন, যুবলীগ নেতা আরশাদুল আলম বাচ্চু, চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান আজিজ, আওয়ামী লীগ নেত্রী জিনাত সোহানা চৌধুরী, এমরান, আব্দুল বাতেন, মোহাম্মদ ফরিদুল আলম, আলী আক্কাস সওদাগর, মসিউর রহমান চৌধুরী, সিটি কলেজ আওয়ামী নেতা খলিলুর রহমান নাহিদ, আব্দুস সালাম মাসুদ, ফোরকান উদ্দিন, মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, তৌহিদুল ইসলাম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি, তালেব আলী, গোলাম মোস্তফা, যুবলীগ নেতা দিদারুল আলম মাসুদ, মোহাম্মদ তৈয়ব, ইকরামুল হাসান, নিজাম উদ্দিন আহাম্মেদ নিজু, সাহাব উদ্দিন, ওমর ফারুক, নাহিদুল ইসলাম মজুমদার।
ব্যবসায়ী ও অপরাধ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে তালিকাভুক্ত রয়েছেন গার্মেন্টস মালিক শাহেদুল ইসলাম, অর্থ লগ্নকারী গোলাম আজম, সাইফুল প্রকাশ কোটিপতি সাইফুল, সাইফুর রহমান, মোহাম্মদ কামাল সারেং, এ কে এম মঞ্জুরুল আলম, মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ, গোলাম সোবহানী, রাশিদা পারভিন রুনু, মাদক ব্যবসায়ী আরমান খান, সিএফএন্ড এজেন্ট মেহেদী হাসান, আশরাফ হোসেন রাজু, খায়েস আহমেদ আরিফ, রাজু আহমেদ, শেখ সেজান, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী তারিকুল ইসলাম, জামালুল ইসলাম, আতিকুর রহমান, সৈয়দা সালেহা পারভীন ও মাদক কারবারি আমজাদ হোসেন। তবে প্রভাবশালী অনেক সাবেক মন্ত্রী ও এমপির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, যা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা প্রশ্ন ওঠেছে।
সিএমপি সূত্র জানায়, এই ১৪৫ জনকে নগরীর ১২ থানার ৩৭৬টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে রয়েছে চাঁদাবাজি, মানিলন্ডারিং, মারাত্মক শারীরিক আঘাত, হত্যা, সন্ত্রাসে অর্থায়ন, জালিয়াতি, মাদক ব্যবসা, প্রতারণা ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের অভিযোগ।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জিয়া হাবিব আহসান বলেছেন, ‘পুলিশ চাইলে আদালতের নির্দেশক্রমে মানিলন্ডারিং আইনে এই মামলাগুলো এন্টি টেররিজম ইউনিট বা সিআইডি-এর মাধ্যমে তদন্ত করতে পারেন। সাধারণ থানার জন্য এসব মামলা তদন্ত করা জটিল।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে সিএমপির এক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জানান, সবকিছু আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তদন্ত করা হবে এবং তদন্তের অভ্যন্তরীণ বিষয় খোলাসা করা হবে না।
সিপি