চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে ‘ভুয়া কমিটি’ গঠনের অপচেষ্টায় বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান নির্বাচিত কমিটির
ক্লাব দখলমুক্ত করার সরকারি প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে
চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবকে অবৈধ দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করার সরকারি প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছানোর সময় হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহিরাগত ও ভুয়া সাংবাদিকদের সমন্বয়ে ‘কথিত কমিটি’ ঘোষণায় কাউকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন ক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি। সালাউদ্দিন মো. রেজা ও দেবদুলাল ভৌমিকের নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতৃবৃন্দ সব ধরনের বিভ্রান্তি এড়িয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে সতর্কতার ডাক দিয়েছেন, যাতে প্রেস ক্লাবের স্বাভাবিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে।
বৃহস্পতিবার (১১ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটির পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়, দখলদারদের এই উদ্যোগ সদস্যদের বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া অপচেষ্টা, যা প্রেস ক্লাবের স্বাভাবিক প্রশাসনিক পরিস্থিতিকে বিঘ্নিত করার শঙ্কা তৈরি করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, প্রেস ক্লাবকে অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করতে সরকারি উদ্যোগ প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঠিক এমন সময়ে বর্তমান দখলদাররা নিজেদের স্বার্থে একটি কথিত কমিটির ঘোষণা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে, যা গভীর উদ্বেগের বিষয় এবং একইসঙ্গে পুরোপুরি বেআইনি।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, ক্লাবের স্থায়ী সদস্যদের কোনো সম্মতি ছাড়াই ভুয়া কমিটির কথা প্রচারের অপচেষ্টা চলছে। গত ১০ ডিসেম্বর বহিরাগত ও ভুয়া সাংবাদিকদের সমন্বয়ে যে কমিটি ঘোষণার কথা বলা হয়েছে, সেখানে কারা এ কমিটি করেছে বা কার সম্মতিতে করা হয়েছে—তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি এটিকে বেআইনি, অগঠনতান্ত্রিক এবং সদস্যদের স্বার্থবিরোধী বলে মন্তব্য করেছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বহিরাগতদের হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে প্রেস ক্লাব দখলের ঘটনাই ছিল মূল সংকট। এরপর তহবিল অপব্যবহারের অভিযোগ চলমান থাকা অবস্থায় আবার কথিত কমিটির প্রচার শিষ্টাচারবহির্ভূত ও গুরুতর অনৈতিক পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়েছে।
প্রেস ক্লাবকে দখলমুক্ত করতে সরকারপক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের তত্ত্বাবধানে সব ধরনের শুনানি সম্পন্ন হয়েছে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়। সদস্যদের প্রত্যাশা পূরণ এখন সময়ের ব্যাপার বলে উল্লেখ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, এ অবস্থায় অতীতের মতো ধৈর্য নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ক্লাব সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো অপতৎপরতায় বিভ্রান্ত না হয়ে সত্যের পথে দৃঢ় থাকা জরুরি। বিজয় নিশ্চিত বলেও বিবৃতিতে মত দেওয়া হয়। পাশাপাশি বলা হয়, ভবিষ্যতে সদস্যদের বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের সব অপকর্মের হিসাব নিতে প্রস্তুত থাকতে হবে এবং নৈতিক অবস্থান অটুট রাখতে হবে।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দখল করে জুয়া-চাঁদাবাজি
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দখল করে গত একবছর ধরে সেখানে জুয়া চলছে—এমন খোলামেলা মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্যবিদায়ী তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আন্তর্জাতিক তথ্য অধিকার দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে মাহফুজ আলম বলেন, ‘প্রেস ক্লাব যেভাবে দখল হয়ে বসে আছে। চিটাগাং প্রেস ক্লাবের ইস্যু আমি গত এক বছরে সলভ করতে পারিনি। বিকজ অফ দ্য পলিটিক্যাল পার্টিজ ইনভলভমেন্ট দেয়ার। ওখানে পলিটিক্যাল পার্টি, এবং ওখানে জুয়া চলে, ওখানে আরও কী কী চলে। আমি ওগুলো ডিসিকে বলে বন্ধ করতে পারছি কিছুটা। কিন্তু এই যে প্রেসক্লাবের ইস্যুটা ওখানে রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে এটা এখনও… একটা নির্বাচন হয়নি। এক বছরে একটা নির্বাচন হয়নি, প্রেসক্লাবে, চিটাগাং প্রেসক্লাবে। সো, দিস ইজ দ্য রিয়েলিটি…’
দফায় দফায় হামলা চালিয়ে প্রেসক্লাব দখল
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তরা অন্তত ৪ দফা– ৫, ৬, ১২ ও ১৪ আগস্ট হামলা চালিয়ে প্রেস ক্লাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দেশীয় অস্ত্র, হাতুড়ি–শাবল নিয়ে ফটকের তালা ভেঙে তারা বার বার ক্লাবে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। এরপর পুরো ক্লাব দখল করে নেওয়া হয়। এ সময় তারা পেশাদার সাংবাদিকদের ওপর নারকীয় হামলা চালায়।
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) দক্ষিণ এশিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২৪-২৫-এ সর্বশেষ ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত একটি দল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে হামলা চালায় এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ করে, যাতে অন্তত ২০ জন আহত হন।’
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে প্রায় ১৩ মাস ধরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব একটি সুযোগসন্ধানী চক্রের দখলে রয়েছে। দখলের পর চট্টগ্রামের সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম ক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি অবৈধভাবে ভেঙ্গে দিয়ে নিজে আহ্বায়ক হয়ে ৪ সদস্যের একটি অন্তর্বর্তী কমিটি গঠন করেন। বিএনপির অঙ্গসংগঠন সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ চট্টগ্রাম শাখার আহ্বায়ক জাহিদুল করিম কচি নিজেকে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব ঘোষণা করেন। প্রেসক্লাবের নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি অভিযোগ করেছে, মব সৃষ্টির মাধ্যমে সহিংসভাবে দখল নেওয়ার পর তার নেতৃত্বে ক্লাবের সম্পদ ও নিয়মিত আয় থেকে বিপুল অংকের অর্থ আত্মসাৎ করছে বলে অভিযোগ তুলেছে।
প্রেসক্লাব ফেরত চান পেশাদার সাংবাদিকরা
এর আগে গত সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব দখল ও অচলাবস্থা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে যুক্ত বিবৃতি দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম সাংবাদিক কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি, চট্টগ্রাম টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন চট্টগ্রাম এবং টিভি ক্যামেরা জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নেতৃবৃন্দ।
সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করেন, ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সহযোগিতায় ভাঙচুর ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে এ ক্লাব দখল করা হয়। ওই সময় চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন রহস্যজনকভাবে নীরব অবস্থান নেয়। দখলে নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও তা হয়নি। বর্তমানে প্রশাসনের নাকের ডগায় সপ্তাহে চার দিন ক্লাব প্রাঙ্গণে জুয়ার আসর বসছে। লুট হয়ে যাচ্ছে ক্লাবের নিয়মিত আয়ের বড় একটি অংশ। গোপনে চলছে ক্লাবের বিভিন্ন ফ্লোর ভাড়া দেওয়ার নামে গোপন চুক্তির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অপতৎপরতা।
সাংবাদিক নেতারা বলেন, ‘এর ফলে জেলা প্রশাসককে ব্যানারে রেখে অন্তর্বর্তী কমিটির অপর তিন সদস্য এ ক্লাবকে ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। দখলদারদের চালবাজিসহ নানা বিষয় টের পেয়ে ডিসি এ কমিটি থেকে সরে যান। কিন্তু খণ্ডিত কথিত কমিটি বর্তমানে নানা অপকর্মের জাল আরও বিস্তৃত করেছে। গঠনতন্ত্রের বিধিবিধান না মেনে তারা এ ক্লাবের ৯৬ জন স্থায়ী সদস্যের সদস্যপদ বাতিল ও স্থগিত করেছে। এর পাশাপাশি মনগড়াভাবে অযোগ্য, অসাংবাদিকসহ অনেক অপরাধীকেও ক্লাবের কথিত সদস্যপদ দিয়েছে, যা গঠনতন্ত্র বহির্ভূত ও অবৈধ।
সাংবাদিক নেতারা অভিযোগ করেন, প্রেসক্লাব বর্তমানে চাঁদাবাজদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দখলদারদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় কথিত নতুন সদস্যপদ পাওয়া ব্যক্তিরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভয়ভীতি ও চাপ সৃষ্টি করে চাঁদা আদায় করছে। এমনকি চাঁদাবাজি, ক্লাবের প্যাড ব্যবহার করে অনৈতিক ডিও লেটার দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড ঘটছে। এ ধরনের ঘটনায় কয়েকজন কথিত সাংবাদিক গ্রেফতারও হয়েছেন।
বিবৃতিতে বলা হয়, দখলদারদের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে চট্টগ্রামে কর্মরত সব সাংবাদিক প্রেসক্লাবে আসা-যাওয়া বন্ধ রেখেছেন। তবে সাধারণ সদস্যরা শান্তিপূর্ণ অবস্থান নিয়েই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। সাংবাদিক নেতারা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান, অনতিবিলম্বে দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ২৮৩ জন স্থায়ী সদস্যকে নিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করা হোক।
আন্তর্জাতিক প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে বিএনপিকে দায়ী
আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস (আইএফজে) তাদের দক্ষিণ এশিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২৪-২৫-এ বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ক্রমবর্ধমান সংকট নিয়ে একটি গভীর বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছে। ‘বাংলাদেশ: গণতন্ত্র পুনর্গঠন’ শিরোনামের এই প্রতিবেদনে বিশেষভাবে আলোকপাত করা হয়েছে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার সময় ২০ সাংবাদিকের ওপর নারকীয় হামলার ঘটনার ওপর। বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের প্রাচীন এই আন্তর্জাতিক সংগঠনটি তাদের প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার গণ–অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর সুযোগসন্ধানী দুর্বৃত্তরা অন্তত ৪ দফা– ৫, ৬, ১২ ও ১৪ আগস্ট হামলা চালিয়ে প্রেস ক্লাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। দেশীয় অস্ত্র, হাতুড়ি–শাবল নিয়ে ফটকের তালা ভেঙে তারা বার বার ক্লাবে প্রবেশ করে তাণ্ডব চালায়। এরপর পুরো ক্লাব দখল করে নেওয়া হয়।
আইএফজের প্রেস ফ্রিডম রিপোর্টে সর্বশেষ ঘটনার উল্লেখ করে বলা হয়, ‘২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট বিএনপির সাথে সম্পৃক্ত একটি দল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে হামলা চালায় এবং সাংবাদিকদের উপর আক্রমণ করে, যাতে অন্তত ২০ জন আহত হন।’
আইএফজে তাদের প্রতিবেদনে এসব ঘটনাকে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির অন্যতম প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশন (আইএফজে) হলো বিশ্বব্যাপী সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর বৃহত্তম গ্লোবাল ইউনিয়ন ফেডারেশন। এটি ১৪৬টি দেশের ১৮৭টি সংগঠনের মাধ্যমে ৬ লাখেরও বেশি গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিনিধিত্ব করে। ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আইএফজে বর্তমানে বিশ্বের ১৪০টিরও বেশি দেশে সক্রিয়, যা সাংবাদিকদের জন্য বৈশ্বিক কণ্ঠস্বরের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।
সিপি


