s alam cement
আক্রান্ত
৮১৯৫৯
সুস্থ
৫৫২০৮
মৃত্যু
৯৬২

চট্টগ্রাম মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে টাকার খেলা, অবহেলায় মারা যাচ্ছে বিপুল রোগী

রোগীদের বিপদে রেখে তিন ‘শাহেনশাহ’র সময় কাটে বিলাসী কক্ষে

0

চোখের সামনে একটু একটু করে কমে আসছে অক্সিজেন স্যাচুরেশন। কমতে কমতে ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছেন রোগী। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেড জোন ও ইয়েলো জোনে এখন প্রতিদিনই দেখা যায় এমন মর্মন্তুদ দৃশ্য। একদিকে যখন এমন চিত্র, অন্যদিকে তাৎক্ষণিক সহায়তায় এগিয়ে আসার মূল দায়িত্ব যাদের হাতে সেই নার্সদের মেলে না দেখা। ডাক্তার তো নয়ই। খোদ জোনগুলোর মূল দায়িত্ব যেসব নার্স ইনচার্জের হাতে, তাদের দেখা পাওয়াই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। বিভিন্ন রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব নার্স ইনচার্জরা কক্ষের দরজা বেশিরভাগ সময়েই থাকে বন্ধ। কেউ কেউ মহিলা নার্সদের সঙ্গে গল্পগুজবে মেতে থাকেন ভেতরে। এ সুযোগে অন্য নার্সরা হেসেখেলে সময়টা কাটিয়ে দেন। ফলে রোগীদের অবস্থা যেমন গুরুতর হয়, তেমনি অনেকে বিনা চিকিৎসাতেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।

রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করে জানান, করোনারোগীদের জন্য নির্ধারিত রেড জোন ও ইয়েলো জোনে রোগী ভর্তি করানোর পর থেকেই পদে পদে লাগে টাকা। টাকা ছাড়া সেখানে কিছুই হয় না। ওয়ার্ডে রোগী ভর্তির পরপরই সিট নিতে দিতে হয় ৫০০ টাকা। টাকা দিতে না পারলে অনেক গুরুতর রোগীকেও রেখে দেওয়া হয় হাসপাতালের বারান্দায়। এরপর রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগাতে প্রতিবারই নার্স ইনচার্জের নির্দেশে ২০০ টাকা করে দিতে হয় ওয়ার্ডবয়দের। রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, করোনার রেড ও ইয়েলো জোন দুটোতেই রোগীর জন্য ইনজেকশন কিনে আনার পর সেটা পুশ করাতে নার্সদের প্রতিবারই টাকা দিতে হয়।

জানা গেছে, ইয়েলো ও রেড জোনের দুই ইউনিটে তিন শিফটে ৬ জন করে মোট ১৮ জন ডাক্তার রুটিন ডিউটি পালন করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় না। বেশিরভাগ সময়ই তিন জোনের কোনটাতেই ডাক্তারদের কাছে পান না রোগীরা— এমন অভিযোগ রয়েছে সেই শুরু থেকেই। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের রাউন্ড ডিউটি অনিয়মিত হওয়ায় নার্স ইনচার্জদের খেয়ালখুশি মতোই চলছে এই মুহূর্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসাকেন্দ্রটির করোনা ওয়ার্ড।

বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) দুপুর দেড়টা। চার তলায় করোনার উপসর্গধারী রোগীদের জন্য নির্ধারিত ১৯ নম্বর ইয়েলো জোন থেকে হন্তদন্ত হয়ে বের আসেন সাইমন। এসেছেন ফেনী থেকে। করোনার উপসর্গ নিয়ে মাকে ভর্তি করিয়েছেন। তিনি বললেন, ওয়ার্ডে আনার পরপরই ওয়ার্ডবয় এসে ৫০০ টাকা নিয়ে গেছেন। প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে থাকা তার মাকে মেঝেতে শুয়ে রাখা হয়েছিল। পরে আরও ২০০ টাকা দেওয়ার পর সিটে তুলে দেন আরেক ওয়ার্ডবয়। আর পাশে দাঁড়িয়ে ওঠানো-নামানোর নির্দেশনাগুলো দিচ্ছিলেন একজন। সায়মন বলেন, পরে জানতে পারি তার নাম সাকিবুল হাসান। ইয়েলো জোনের নার্স ইনচার্জ তিনি।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা উপসর্গধারীদের জন্য নির্ধারিত ইয়েলো জোন। (ওপর থেকে) ইয়েলো জোনের নার্স ইনচার্জ সাকিবুল হাসান, রেড জোন-১ এর নার্স ইনচার্জ শফিকুল নূর এবং রেড জোন-২ এর নার্স ইনচার্জ বিপ্লব ব্যাপারী।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা উপসর্গধারীদের জন্য নির্ধারিত ইয়েলো জোন। (ওপর থেকে) ইয়েলো জোনের নার্স ইনচার্জ সাকিবুল হাসান, রেড জোন-১ এর নার্স ইনচার্জ শফিকুল নূর এবং রেড জোন-২ এর নার্স ইনচার্জ বিপ্লব ব্যাপারী।

জানা গেছে, ইয়েলো জোনে সাকিবুল হাসানের অধীনে কাজ করছেন ১৭ জন নার্স। কিন্তু অভিযোগে জানা গেছে, সাকিবুল হাসান এদের ওপর ‘দায়িত্ব’ দিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়েই স্টোররুমে দরজা বন্ধ করে ঘুমান। এই সুযোগে অন্য নার্সরা তাদের খেয়ালখুশিমতো সময় কাটান।

Din Mohammed Convention Hall

বুধবার (৩০ জুলাই) দুপুর ১টা ৪৫ মিনিটে ‘রোগীর স্বজন’ সেজে ইয়েলো জোনের ভেতরে ঢুকে সরাসরিই দেখা গেল অনিয়ম ও অবহেলার করুণ চিত্র। কোনো দিকে অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছেন রোগীরা। এক রোগীর নাক থেকে অক্সিজেনের নল খুলে গেলেও পাশে থাকা নার্স সেটি লাগিয়ে না দিয়েই হাস্যমুখে চলে গেলেন বাইরে। দেখা গেল, নতুন রোগী আসলে টাকা হাতে বুঝে পাওয়ার পর রোগীর বেড ও অক্সিজেন সরবরাহ করার দৃশ্যও। পুরো ওয়ার্ড ঘুরেও নার্স ইনচার্জ সাকিবুল হাসানকে দেখা যায়নি। তিনি কোথায় জানতে চাইলে এক নার্স জানান, তিনি রেস্টে আছেন।

এভাবে অনিয়ম-অবহেলা ও চিকিৎসা পেতে দীর্ঘসূত্রতার কারণে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেড জোন ও ইয়েলো জোনে রোগীদের অবস্থা গুরুতর হওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে দ্রুতগতিতে। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে আসা ও করোনা পজিটিভ উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী। অথচ চট্টগ্রামের প্রধান এই হাসপাতালে অনেক আশা নিয়ে প্রতিদিনই ভর্তি হতে আসছেন প্রচুর করোনারোগী— যাদের বেশিরভাগেরই অবস্থা গুরুতর।

নাম প্রকাশ করার শর্তে ইয়েলো জোনের একাধিক রোগী জানান, রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে নার্স ইনচার্জ সাকিবুল হাসান খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। উচ্চস্বরে গালিগালাজও করেন। কিন্তু রোগী যেহেতু ভেতরে থাকেন, তাই নিরবে সেসব সয়ে যেতে হয় স্বজনদের।

ইয়েলো জোনের এক নারী রোগীর ভাই আলমগীর আলম (ছদ্মনাম) জানান, ‘এই ওয়ার্ডে প্রতিদিনই রোগী মারা যাচ্ছে। ওয়ার্ডে আসার পরপরই শ্রেফ অবহেলার কারণে মারা গেছেন— এমনও দেখেছি অনেক। নার্স ও ডাক্তাররা যদি সাথে সাথে রোগীটার চিকিৎসা শুরু করতেন, হয়তো রোগীটি বেঁচে যেতে পারতো। শুধু অক্সিজেন সিলিন্ডার লাগানোয় দেরি করায় অনেক রোগীর মৃত্যু হতেও দেখছি প্রায় প্রতিদিনই।’

এসব বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে ইয়েলো জোনের নার্স ইনচার্জ সাকিবুল হাসানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুই বলতে পারবো না। যা জানার ডাইরেক্টর (পরিচালক) স্যারের কাছ থেকে জেনে নিন।’

এ তো গেল ইয়েলো জোনের চিত্র। অত্যন্ত স্পর্শকাতর রেড জোনের দুই ইউনিটেও চলছে একই অবস্থা। রেড জোন-২ ইউনিটের নার্স ইনচার্জ বিপ্লব ব্যাপারী। নির্দিষ্ট সময়ে ওয়ার্ডে ঢুকলেও অধ্যাপকদের রুটিন রাউন্ডের পর স্টোর রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেন তিনি। এটি তার নিত্যদিনের রুটিন কাজ। ওই ইউনিটের নিজস্ব স্টোররুমটিও তিনি সাজিয়েছেন তার পছন্দমতো। সেখানে রয়েছে তার জন্য শোয়ার খোট। রয়েছে কম্পিউটার টেবিল। টেবিলের চারপাশে সাজানো চেয়ার। চায়ের ফ্লাস্ক। দুই-তিনটি মোবাইল সারি সারি। রয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট লাইনও। প্রফেসরদের রুটিন রাউন্ডের পর এ কক্ষে সময় কাটানো তার খুব পছন্দের— বেশিরভাগই ঘুমিয়ে, আবার কখনও নারী নার্সদের সাথে গল্পগুজব করে। ওই ইউনিটে বিপ্লব ব্যাপারীর তত্ত্বাবধানে রয়েছেন আরও ১৪ জন নার্স। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই নার্সদের কয়েকজন এই প্রতিবেদককে জানান, বিপ্লব ব্যাপারী স্টোররুমের দরজা বন্ধ করে নারী নার্সদের সাথে আপত্তিকর আচরণ করেন। তার ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস করেন না।

রেডজোন-১ ইউনিটের দায়িত্বে রয়েছেন নার্স ইনচার্জ শফিকুল নূর। অন্য দুজনের মতো স্টোররুম নয়, শফিকুল নূর বেশিরভাগ সময় কাটান আইসিইউতে। আইসিইউতে সিট ম্যানেজের নামে শফিকুল মোটা অংকের ‘ধান্ধা’ করেন— এমন বহু অভিযোগ মিলেছে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে। আইসিইউর প্রতিটি সিটের জন্য তাকে বড় অংকের টাকা দিতে হয় রোগীর স্বজনদের— চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এটিই অলিখিত নিয়ম।

দেখা গেছে, রেডজোন-১ ইউনিটে রোগীর চাপ বেশি হওয়ায় ওয়ার্ড ছেড়ে বারান্দায়ও করোনারোগীদের রাখা হয়েছে। কিন্তু এই রেডজোনে গত বুধবার (২৮ জুলাই) গিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও নার্স ইনচার্জ শফিকুলের দেখা পাওয়া যায়নি। সঙ্গে আসা স্বজনদেরই করোনারোগীদের দেখভাল করতে দেখা গেছে। অক্সিজেনের সিলিন্ডার লাগানোর জন্য নার্সকে ডেকেও পাচ্ছেন না রোগী ও তাদের স্বজনরা।

ওয়ার্ড থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও ইনজেকশন না দেওয়ার অভিযোগও করেছেন একাধিক রোগীর স্বজন। হিমেল নামে এক রোগীর স্বজন জানান, তিনি তার বাবাকে ২৪ জুলাই রেডজোন-১ এ ভর্তি করিয়েছেন। ২৪ হাজার টাকা সঙ্গে এনেছিলেন। ওষুধ কিনতে কিনতে সব টাকাই শেষ হয়ে গেছে। ওয়ার্ড থেকে ইনজেকশন না পাওয়ার কথা জানান হিমেলও।

গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) করোনা উপসর্গধারী রোগীদের জন্য নির্ধারিত ইয়েলো জোনে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩৪ জন এবং ওইদিনই সেখানে মারা গেছেন ৫ জন। ওইদিন পর্যন্ত সেখানে রোগীর সংখ্যা ছিল ১১৯ জন। অন্যদিকে চালু হওয়ার পর থেকে ওই জোনে ভর্তি হওয়া মোট রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ৫৩৪ জন। বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) পর্যন্ত ইয়েলো জোনে মারা গেছেন ১ হাজার ৫৬০ জন।

অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) করোনা পজিটিভ রোগীদের জন্য নির্ধারিত রেডজোনের দুই ইউনিটে করোনারোগী ভর্তি হন ৩১ জন। চালু হওয়ার পর থেকে ওয়ার্ডটিতে মোট রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ১১১ জন। বৃহস্পতিবার (২৯ জুলাই) পর্যন্ত সেখানে মোট মারা গেছেন ৪৩৬ জন।

সিপি

ManaratResponsive

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রকাশিত হবে না।

ksrm