ডেঙ্গুর হানা লিভারে, জন্ডিসের সঙ্গে দেখা দিচ্ছে হেপাটাইটিসও

ফ্যাটি লিভার থাকলেই বিপদ, মারা যাচ্ছে ড্যামেজ হয়েও

দিন দিন জটিল হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। এসব রোগীদের বেশিরভাগের দেখা দিচ্ছে লিভার জটিলতা। বিশেষ করে যাদের ফ্যাটি লিভার তাদের বাড়ছে বিপদ। শরীরে দেখা দিচ্ছে জন্ডিস, অনেকের হচ্ছে হেপাটাইটিসও। এতে ডেঙ্গু পরবর্তী লিভার ড্যামেজ হয়ে মারা যাচ্ছে রোগী।

এই অবস্থায় ডাক্তাররা ডেঙ্গুকে হেপাটাইটিসের দোসর মনে করছেন। তাই ডেঙ্গু হলে দিচ্ছেন আটদিনের পূর্ণ বিশ্রামে থাকার পরামর্শ।

গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ডাক্তাররা জানান, করোনার মতো ডেঙ্গু ভাইরাসেরও বিভিন্ন প্রজাতি বা স্ট্রেন আছে। একজন রোগী ডেঙ্গুর যে স্ট্রেনে আক্রান্ত হবেন, সুস্থ হওয়ার পর সেই স্ট্রেনের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার যদি ওই ব্যক্তি ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্য স্ট্রেনে আক্রান্ত হন তবে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা আর কাজ করবে না। চার-পাঁচদিনের মাথায় জ্বর কমবে ঠিকই। কিন্তু ডেঙ্গুর সেই স্ট্রেন ডেকে আনে হেপাটাইটিস। ফলে রোগীর পেটে পানি চলে আসে।

s alam president – mobile

চট্টগ্রামের চন্দনাইশের শুচিয়া গ্রামের টিটু শীল রোববার (২৩ জুলাই) নগরীর বেসরকারি হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারে ডেঙ্গু পরবর্তী লিভার ফেইল হয়ে মারা গেছেন। তার স্ত্রীর বোনের জামাই সুমন শীল বলেন, ‘টিটুর নগরীর জিইসিতে সেলুন ব্যবসা ছিল। আগে থেকেই তিনি ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত ছিলেন। গত শনিবার তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি হন। তার পেটে পানি চলে আসায় শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ডাক্তারের পরামর্শে তাকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। রোববার রাতে তিনি মারা যান।’

জানা গেছে, লিভার সাধারণত দু’ভাবে আক্রান্ত হয়। ডেঙ্গু ভাইরাস সরাসরি লিভারকে আক্রান্ত করতে পারে। অন্যদিকে ডেঙ্গু ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার কারণে মানব শরীরের প্রতিরক্ষা সিস্টেম অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যাকটিভ হলে লিভার ইনজুরি হতে পারে। ইমিউন সিস্টেম অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করলে তা ভাইরাসের পাশাপাশি লিভার কোষকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। লিভার কোষ এবং কাপফার কোষ হলো ডেঙ্গুর প্রধান টার্গেট। লিভার কোষে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রবেশ করলে অন্তর্নিহিত প্রসেস দ্বারা লিভার কোষগুলোর মৃত্যু হতে থাকে।

গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ডাক্তাররা আরও জানান, প্রথমবার ডেঙ্গু হলে কিন্তু এমনটা হয় না। কারণ শরীরের মধ্যে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। ডেঙ্গু ভাইরাসের সফট টার্গেট লিভার। অর্থাৎ একাধিকবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে এমন সমস্যা হতে পারে। একইসঙ্গে লিভারের সমস্যার সঙ্গে আবার কিছু রোগীর সেই সময় প্লাটিলেট কমতে শুরু করে। তাই একাধিক রোগের চিকিৎসা একই সময়ে করতে হয়।

Yakub Group

হেপাটাইটিসের ফলে লিভার থেকে প্রচুর পরিমাণে stimulatory secretion বা উৎসেচক ক্ষরণ হতে শুরু করে। তাই রোগীর স্বাভাবিক খাবার হজমের ক্ষমতা কমে যায়। এই সময়ে রোগীকে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার অর্থাৎ পান্তা ভাত বা হালকা মসলাযুক্ত তরকারি ও প্রচুর পানি খেতে হবে। দেখতে হবে রোগীর শরীর থেকে রক্তপাত হচ্ছে কি-না? পেটে চাপ পড়ে এমন কোনও কাজ করা উচিত হবে না। ডেঙ্গু পজিটিভ হওয়ার পর টানা আটদিন পুরো বিশ্রামে থাকতে হবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান ডা. এরশাদ উদ্দিন আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এবার ডেঙ্গু আক্রান্তের পর লিভার ডিস্টার্ব নিয়ে কিছু রোগী আসছে। মারা যাওয়াদের মধ্যে প্রায় লিভার ফাংশন ড্যামেজ হয়ে মারা যাচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর লিভার ডিস্টার্ব যখন শুরু হয়, রোগীর শরীরে তখন জন্ডিস দেখা যায়। এমনকি অনেক রোগীর সেটি হেপাটাইটিস পর্যায়েও চলে যাচ্ছে। একইসঙ্গে যাদের আগে থেকে লিভার ও কিডনি জটিলতা ছিল, তারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে বাঁচানো যাচ্ছে কম।’

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এমএ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার কারণে লিভারে নানা ধরনের পরিবর্তন আসে। এই সময় লিভার বড় হয়ে যায়, রক্তে লিভার এনজাইম এএলটি ও এএসটি-এর পরিমাণ বেড়ে যায়। কারও কারও ক্ষেত্রে এই অবস্থা একিউট লিভার ফেইলিওর করতে পারে। রোগী সাধারণত পেটে ব্যথা, বমি ও ক্ষুধামন্দায় ভোগে, জন্ডিস দেখা দেয়। অনেক ক্ষেত্রে রোগীর রক্তের বিলিরুবিনের মাত্রা বেড়ে যায়। এসব রোগীকে ডেঙ্গু চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ে অন্যান্য রোগের প্রতি নজর চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়।’

এদিকে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আরও ৯৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন। সোমবার (২৪ জুলাই) চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে দেওয়া প্রতিবেদনে এই তথ্য জানা গেছে। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে ৫৭ এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৩৬ জন ভর্তি হয়েছেন। বর্তমানে হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন আছেন ২৮৩ জন রোগী।

আরও জানা গেছে, জুলাই মাসে এক হাজার ৬৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ১৩ জন। জুনে আক্রান্ত ২৮২ জন, মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। মে মাসে ৫৩ জন, এপ্রিলে ১৮ জন, মার্চে ১২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন ও জানুয়ারিতে ৭৭ জন আক্রান্ত হন। জানুয়ারিতে আক্রান্তদের মধ্যে মারা যান তিনজন।

মারা যাওয়া ২২ জনের মধ্যে ১১ জনই শিশু। বাকিদের মধ্যে পুরুষ ছয় ও নারী পাঁচজন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!