দফায় দফায় চাঁদাবাজি চট্টগ্রামের বৃক্ষমেলায়, নেপথ্যে কলেজ ছাত্রলীগ ও কাউন্সিলরের অনুসারীরা

মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠানই নিয়েছে ২০ হাজার করে

ভ্যানে করে নজরুল আইসক্রিম বিক্রি করেন। সারাদিনে বিক্রি হাজারদুয়েকের মতো। মেলায় বেশি বেচাকেনার আশায় কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আনসারকে একহাজার টাকা মাসোহারা দিয়ে মেলায় দোকান বসান তিনি। দু-একদিন পর পর আরও টাকা নিয়ে যান চট্টগ্রাম কলেজের সেই ছাত্রলীগ নেতা। তবে আনসারকে টাকা দিয়েও দুঃখ নেই নজরুলের। কারণ তার নাম বললে চাঁদা নিতে আসা বাকি দলগুলো আর টাকা চায় না।

চট্টগ্রাম নগরীর মানুষকে গাছ সম্পর্কে নতুন করে জানাতে চট্টগ্রাম কলেজের মাঠে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে এবং তিলোত্তমা নামক একটি সংগঠনের সহযোগিতায় করা হয় বৃক্ষমেলার। সপ্তাহব্যাপী এই মেলা চলার কথা ছিল। সেই হিসেবে ৮ অক্টোবর শুরু হয়ে শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) আনুষ্ঠানিক সমাপনী অনুষ্ঠানও করা হয়। তবে সেই মেলা চলছে এখনও। মেলা কবে শেষ হচ্ছে এ প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই আয়োজকদের। তবে মেলাকে ঘিরে চলছে কয়েক স্তরের চাঁদাবাজি। স্থানীয় কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু ও চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নামে তোলা হচ্ছে দফায় দফায় চাঁদা।

দফায় দফায় চাঁদাবাজি চট্টগ্রামের বৃক্ষমেলায়, নেপথ্যে কলেজ ছাত্রলীগ ও কাউন্সিলরের অনুসারীরা 1

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেলা শেষ হওয়ার পরও মেলাকে ঘিরে চলা কয়েক স্তরের চাঁদাবাজির জন্যই মূলত জিইয়ে রাখা হচ্ছে এই মেলাকে। মেলাকে ঘিরে বসা প্রায় অর্ধশত কসমেটিক্স ও খাবারের দোকানকে কেন্দ্র করে বিপুল পরিমাণের চাঁদার ভাগের জন্যই এক সপ্তাহের মেলাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অনির্দিষ্ট সময় ধরে।

মেলায় ১৮টি নার্সারি স্টল সাজালেও প্রতিটি দোকান থেকে ২০ হাজার টাকা করে মেলার খরচ বাবদ টাকা তোলে মেলার সহযোগিতায় দেওয়া প্রতিষ্ঠান ‘তিলোত্তমা’। ৭ দিনের জন্য এই মেলা আয়োজন করা হলেও মেলা চলবে অন্তত ১৫ দিন— আয়োজন সহযোগী প্রতিষ্ঠানের এমন মৌখিক আশ্বাসে এই টাকা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেনি নার্সারিগুলো। কিন্তু ওই টাকা সিটি কর্পোরেশন পেয়েছে, নাকি তিলোত্তমা নিয়েছে— সেই প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারেনি।

Yakub Group

জানা গেছে, নার্সারি দোকানিদের ২০ হাজার টাকা ছাড়াও বড় অংকের একটি টাকা এসেছে মেলা ঘিরে বসা খাবার ও কসমেটিক্সের দোকানগুলো থেকে। প্রতিটি খাবার দোকান থেকে ১০ হাজার টাকা করে এককালীন ও প্রতিদিন ৩০০ টাকা করে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে কয়েক দফায়। এছাড়াও খাবারের দোকানগুলোতে খাবার খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর টিনুর অনুসারী ও কলেজ ছাত্রলীগের কর্মীদের বিরুদ্ধে।

তবে চাঁদার বিষয়টি স্বীকার করলেও তারা কেউ ‘নিজের কর্মী নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ১৬ নম্বর ওর্য়াডের কাউন্সিলর নূর মোস্তফা টিনু। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যারা চাঁদাবাজি করছে তারা কেউ আমার অনুসারী না, তারা বহিরাগত। আর কেউ যদি আমার নাম বিক্রি করে চাঁদাবাজি করে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

মেলা আর কতদিন চলবে— এমন প্রশ্নের জবাবে কাউন্সিলর টিনু বলেন, ‘আজকেই শেষ, আজকে প্যান্ডেল খোলা হচ্ছে। যারা কাছে, তারা আজকেই চলে যাবেন। আর দূরের দোকানিরা কাল সকালের মধ্যে চলে যাবেন।’

তবে মেলায় আসা একাধিক দোকানি জানান, আগামীকাল (সোমবার) নয় বরং আগামি পরশুই (মঙ্গলবার) শেষ হচ্ছে মেলা। তবে মেলার সময় নিয়ে আয়োজকরা দোকানিদের সঙ্গে ‘প্রতারণা’ করেছেন বলেন অভিযোগ করেন একাধিক দোকানি।

এদিকে জানা গেছে, মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান ও কাউন্সিলর টিনুর অনুসারীরা ছাড়াও আরও একটি পক্ষ মেলায় প্রভাব বিস্তার করছে। চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে এবং নিজেদের কলেজের মাঠে দোকান দেওয়ার কারণ দেখিয়ে ভাসমান ও খাবারের দোকানগুলোতে চাঁদা দাবি করেন কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এই চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে একাধিকবার মারামারি ও দোকান থেকে জিনিস ছুঁড়ে ফেলার মতোও অভিযোগ রয়েছে কলেজ ও চকবাজারের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে।

তবে খাবারের প্রতিটি দোকানই চাঁদা দিয়ে গেলেও প্রকাশ্যে মুখ খুলতে রাজি হননি তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ফুচকা বিক্রেতা অভিযোগ করেন, তার দোকানটি বসানোর জন্য দুই দফায় ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। যার মধ্যে ৫ হাজার নিয়েছে টিনুর নামে তার কর্মীরা এবং বাকি ৫ হাজার নিয়েছেন কলেজ ছাত্রলীগের নামে আরমান নামের একজন। ১০ হাজার টাকা দেওয়ার পরও ফ্রিতে খাবার না দেওয়ায় তার ফুচকাগুলো একবার ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়।

তবে মেলার একাধিক নার্সারি স্টলের মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তিলোত্তমার শাহেলা আবেদীনের হাতেই মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দিন ১০ হাজার টাকা এবং গত শুক্রবার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির দিন বাকি ১০ হাজার টাকা দেন নার্সারীর দোকানিরা। তবে এই টাকার বিনিময়ে কোনো ধরনের রশিদ দেয়নি মেলা আয়োজন সহযোগী প্রতিষ্ঠানটি।

এক নার্সারি মালিক জানান, এর আগে যতগুলো মেলা হয়েছে তাতে পে-অর্ডারের মাধ্যমেই নির্ধারিত ফি দিয়ে স্টল বুকিং করেছেন সবাই। কিন্তু এবারেই তার ব্যতিক্রমটা দেখা গেছে। টাকা দেওয়ার পরও কাঙ্খিত সুযোগ সুবিধা পায়নি বলে আয়োজকদের প্রতি ক্ষোভ জানান মেলায় আসা দোকানিরা।

তবে দিনশেষে হতাশা ও ক্ষতিতেই দোকান ছাড়তে হচ্ছে দোকানীদের। মেলার অব্যবস্থাপনা, বৃষ্টি ও চাঁদাবাজির জন্য আয়োজকদেরই দোষ দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এর আগে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে একাধিক মেলায় অংশগ্রহণ করলেও এবারের মত বাজে পরিস্থিতি আগে কখনও দেখতে হয়নি বলে জানান তারা।

এদিকে বেশকিছু স্টলের কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করলেও সবার কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়নি বলে জানান মেলার সহযোগী প্রতিষ্ঠান তিলোত্তমার কর্ণধার শাহেলা আবেদীন।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘মেলার একটা খরচ আছে। সেগুলোর জন্যই টাকাটা নেওয়া হয়েছে। তবে সবাই ২০ হাজার টাকা দেয়নি।’

তবে মেলার এই টাকা সিটি কর্পোরেশনের কোষাগারে যাবে, নাকি তিলোত্তমার কাছে যাবে— এমন প্রশ্ন করতেই উত্তেজিত হয়ে যান তিনি।

এদিকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে মেলার আয়োজন হলেও অভিযোগের বিষয়ে সংস্থাটির একাধিক কর্তাব্যক্তির সাথে কথা বললেও কেউ দায়িত্ব নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm