পবিত্র রমজান: আত্মিক পরিশুদ্ধি ও মানবিকতার মাস

পবিত্র মাহে রমজান আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। মুসলিম জাতির ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনে রমজানের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি পবিত্র কুরআন নাজিলের মাস, ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ের মাস। রমজান মুমিনের জন্য শারীরিক, আর্থিক, চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলীর উৎকর্ষ সাধনের মাস। এ মাসে সহমর্মিতা, পারস্পরিক প্রীতি-ভালোবাসা ও সুন্দর আচরণের মাধ্যমে ঈমানি সৌধ গড়ে ওঠে।

রমজান শুরুর আগেই রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রমজান সহমর্মিতার মাস। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ধনী-গরিব, সক্ষম-অক্ষম, পেট ভরে খাওয়া ব্যক্তি ক্ষুধার্তের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াবে—এটিই এ মাসের বড় শিক্ষা। রমজানের অল্প কয়েক দিন বাকি। এখনই সময় অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়ে অফুরন্ত সাওয়াব অর্জনের। ইবাদত-বন্দেগি ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটির মাধ্যমে পাপ মোচনের এ মাসে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করেছেন, যে ব্যক্তি রমজান পেল কিন্তু পাপ মোচন করতে পারল না, তার ধ্বংস অনিবার্য। তাই পূর্ববর্তী আলেম ও আল্লাহপ্রেমী বান্দারা রমজানের আগেই এ মাসের প্রস্তুতি নিতেন।

মুসলমানদের জন্য রমজান আল্লাহর এক বিশাল নেয়ামত। এটি পবিত্রতা, বদান্যতা, সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মাস। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে এ মাসে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটে। ধনী-গরিবের মধ্যে দয়া, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা জাগ্রত হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানকে ‘শাহরুল মুওয়াসাত’ বা সহমর্মিতা ও সহানুভূতির মাস বলেছেন। রোজা পালন সমাজে সাহায্য-সহযোগিতা, সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রদর্শনের অন্যতম মাধ্যম।

রমজানে সমাজের অসহায়, হতদরিদ্র, দুর্বল, পীড়িত, অনাথ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়ানো প্রতিটি রোজাদারের কর্তব্য। ধনী-গরিব সবাই মিলে ইবাদতের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান গড়ে তোলেন। প্রকৃত রোজাদার কারও ক্ষতি করেন না, বরং পরোপকারে ব্যস্ত থাকেন। রমজান সাম্য, মৈত্রী, ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা দেয়।

সমাজে মানবতার ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় রমজানের রোজার ভূমিকা অপরিসীম। রোজাদার ব্যক্তি সম-অধিকারের কথা উপলব্ধি করেন এবং গরিবদের প্রতি সদয় হন। ধনী রোজাদাররা দরিদ্রদের সেহরি-ইফতারের ব্যবস্থা করেন, শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন এবং তাদের কাজের চাপ কমিয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানে যারা দাস-দাসী ও শ্রমিকদের প্রতি সদয় হন, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করেন এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা করেন।

রমজানে রোজাদার ব্যক্তি গালিগালাজ, ঝগড়া-বিবাদ ও অশ্লীল কথা থেকে দূরে থাকেন। তারা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রোজাদার ব্যক্তি যদি কাউকে গালি দেয় বা ঝগড়ায় জড়ায়, তবে সে যেন বলে, “আমি রোজাদার।” রমজানের শিক্ষা সারাবছর ধরে রাখলে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় না।

রমজানে ধনী রোজাদাররা গরিবের দুঃখ-কষ্ট ও ক্ষুধার জ্বালা অনুভব করেন এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। এ মাসে দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন ও তাদের সাহায্য করা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য। রোজাদারদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অনেক অসহায় মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। রমজান সমাজে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা গড়ে তোলার মাস।

রমজান নিকটবর্তী হলে ওমর (রা.) নিম্নোক্ত দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন:
“হে আল্লাহ! আমাদের বেশি দান করুন, আমাদের কম দেবেন না। আমাদের সম্মান দিন, আমাদের লাঞ্ছিত করবেন না। আমাদের দান করুন, আমাদের বঞ্চিত করবেন না। আমাদের অগ্রগামী করুন, অন্য কাউকে আমাদের ওপর অগ্রগামী করবেন না। আমাদের সন্তুষ্ট করুন এবং আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকুন।”

রমজানে মুসলিম উম্মাহ তারাবিহ, এতেকাফ ও শবে-কদরের ইবাদতে মগ্ন হয়। ধনী মুসলমানরা জাকাত প্রদানের মাধ্যমে আত্মিক ও আর্থিক পবিত্রতা অর্জন করেন। এ মাসে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি করা প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণ ও সঠিকভাবে ইবাদত করার তাওফিক দিন। আমীন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm