পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় বিশেষায়িত ‘মাউন্টেইন ব্যাটালিয়ন’ গঠনের যে বিশাল পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তার ব্যয় এবং যৌক্তিকতা নিয়ে খোদ পরিকল্পনা কমিশনের ভেতরেই নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দুর্গম পাহাড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে ৬৬৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা ব্যয়ের এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের প্রস্তাব বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় তোলা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের নেওয়া এই বিশাল কর্মযজ্ঞের বিপুল ব্যয়ের যৌক্তিকতা এবং এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এখন চলছে পর্যালোচনা ও চুলচেরা বিশ্লেষণ।
ব্যয়বহুল অবকাঠামো ও বিশাল বাজেট
প্রস্তাবিত প্রকল্পে ব্যয়ের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বেশ চমকপ্রদ। তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে তিনটি আর্মড পুলিশ মাউন্টেইন ব্যাটালিয়ন ও এর সদর দপ্তর স্থাপনের জন্য বিশাল বাজেটের সংস্থান রাখা হয়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য এই প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা দেবে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)।
ব্যয়ের বিভাজন অনুযায়ী, ২০২৫–২৬ অর্থবছরে ১৯১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা, পরের বছর ২৩৮ কোটি ১১ লাখ এবং শেষ বছরে ২৩৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এর মধ্যে পাহাড়ের বন্ধুর পথে চলাচলের উপযোগী ১৫৫টি যানবাহন কিনতেই ব্যয় হবে ১১২ কোটি টাকা। এ ছাড়া আবাসিক ও অনাবাসিক ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪৮৫ কোটি টাকারও বেশি।
নিরাপত্তার যুক্তি ও বাস্তবতার চ্যালেঞ্জ
প্রকল্প প্রস্তাবে এই বিপুল ব্যয়ের সপক্ষে বলা হয়েছে, পার্বত্য অঞ্চলে জেলা পুলিশের পক্ষে আধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সংঘবদ্ধ অপরাধী দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে মামলা তদন্ত ও দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকায় থানা-পুলিশের সদস্যদের পক্ষে দুর্গম পাহাড়ে কার্যকর ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া শান্তিচুক্তির প্রেক্ষাপটে পর্যায়ক্রমে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেওয়া হলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এই বিশেষায়িত মাউন্টেইন পুলিশের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। ব্যাটালিয়নটি গঠিত হলে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে বিদ্যমান কোন্দল নিরসন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান করা সম্ভব হবে বলেও দাবি করা হয়েছে। তবে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর এই যুক্তি পাহাড়ের বাস্তবতায় কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তিন বছর আগের তোড়জোড়
এর আগে ২০২২ সালের ২৫ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিন পার্বত্য জেলায় আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কার্যক্রম শুরু করার প্রশাসনিক অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে পার্বত্য জেলায় ডিআইজি এপিবিএন-এর কার্যালয় স্থাপনসহ তিন জেলায় তিনটি পৃথক আমর্ড পুলিশ মাউন্টেইন ব্যাটালিয়ন সৃষ্টির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সভায় প্রস্তাব অনুমোদন হয়। ডিআইজি কার্যালয় ও তিনটি ব্যাটালিয়ন সৃষ্টির জন্য ২৬৫০ টি পদ সৃজনের অনুমতি চেয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০২২ সালের ২৭ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এজন্য ২২৬০টি পদ সৃজন করে। এরপরই আর্মড পুলিশ মাউন্টেইন ব্যাটালিয়ন গঠনের কার্যক্রম শুরু হয়। এজন্য ১৮ এপিবিএন রাঙামাটি, ১৯ এপিবিএন বান্দরবান ও ২০ এপিবিএন খাগড়াছড়ি গঠন করা হয়।
ওই সময় জানানো হয়েছিল, আর্মড পুলিশ মাউন্টেইন ব্যাটালিয়নে ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা প্রধান থাকবেন। ডিআইজি কার্যালয়ে দুজন এডিশনাল ডিআইজি এবং পৃথক তিন জেলা ব্যাটালিয়নে একজন করে মোট তিনজন অতিরিক্ত ডিআইজি থাকবেন। এই তিনটি ব্যাটালিয়নে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেয়া ২ হাজার ২৬০টি পদের মধ্যে একজন ডিআইজি, পাঁচজন অতিরিক্ত ডিআইজি, ১১ জন পুলিশ সুপার, ২১ জন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, ২১ জন সহকারী পুলিশ সুপার, চারজন মেডিক্যাল অফিসার, ৭১ পরিদর্শক, ২৪৭ উপপরিদর্শক, ২৫৮ সহকারী উপপরিদর্শক, ৩৯৬ জন নায়েক এবং ১ হাজার ২২৫ জন কনস্টেবল রয়েছেন।
আর্মড পুলিশ মাউন্টেন ব্যাটালিয়ন গঠনের প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয় ঘুরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন পর্যন্ত যাওয়ার আগেই তৎপরতায় ধীরগতি নেমে আসে।
পরিকল্পনা কমিশনের সংশয় ও প্রশ্ন
বিশাল অঙ্কের এই প্রকল্পের যৌক্তিকতা ও পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে পর্যবেক্ষণের ‘নীতি’ নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সেক্টর ডিভিশন। কমিশনের মতামতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পটি গ্রহণের প্রকৃত যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সংস্থা এবং অংশীজনদের গভীর মতামত নেওয়া প্রয়োজন। কোনো যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই বা ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়াই এমন বড় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
বিশেষ করে পার্বত্য এলাকার সংবেদনশীল পরিবেশে এত বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করলে প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। বিশাল এই ব্যয়ের বিপরীতে জননিরাপত্তার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত হবে সেটিই এখন বড় আলোচনার বিষয়।


