ভুয়া কোম্পানি, জাল কাগজপত্র আর প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রচ্ছায়ায় গড়ে উঠেছিল একটি সুপরিকল্পিত লুটপাটের নেটওয়ার্ক। সেই চক্রের মূল হোতা হিসেবে এবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রাডারে এসেছেন দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ, সঙ্গে তার সহযোগী আরেক বড় জালিয়াত পি কে হালদারও।
রিলায়েন্স ফাইন্যান্স (বর্তমানে আভিভা ফাইন্যান্স) থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে ২৭১ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা করেছে দুদক। মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় রয়েছেন আলোচিত পিকে হালদারসহ ১৫ জন, যার মধ্যে এস আলম পরিবারের একাধিক সদস্য ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের একঝাঁক সাবেক কর্মকর্তা রয়েছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলাগুলো শুধু বড় অঙ্কের অর্থ নয়, দেখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভুয়া কাগজপত্রের ফাঁদে পড়ে হয়ে ওঠে লুটপাটের হাতিয়ার।
বুধবার (২ জুলাই) দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে এসব মামলা দায়ের করা হয় বলে জানিয়েছেন সংস্থার মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন। প্রতিটি মামলায় ১৩ জন করে আসামি থাকলেও বেশিরভাগ আসামি একাধিক মামলায় অভিন্ন বলে জানা গেছে।
মোস্তফা অ্যান্ড কোম্পানির নামে ৯৪ কোটি টাকা হাওয়া
দুদকের এই মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ভুয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড কোম্পানির নামে মেয়াদি ঋণ গ্রহণ করে সেই টাকা এস আলম সুপার এডিবল অয়েল লিমিটেডে হস্তান্তর করা হয়। এতে ৯৪ কোটি ৬৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ এবং ৩২ কোটি ৫০ লাখ টাকা পাচার করা হয়েছে।
এই মামলার প্রধান আসামিরা হলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ, তার ভাই আবদুস সামাদ লাবু ও তার স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, ভাই আবদুল্লাহ হাসান, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি বর্তমানে ভারতে অন্তরীণ প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ও তার বান্ধবী হিসেবে পরিচিত নাহিদা রুনাই। আসামি হয়েছেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের কর্মকর্তারা— রাশেদুল হক, কাজী আহমেদ জামাল, জুমারাতুল বান্না, জহির আহমেদ, টিপু সুলতান, মো. ইসহাক। এছাড়া আসামির তালিকায় নাম রয়েছে ভুয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড কোম্পানির কথিত মালিক গোলাম মোস্তাফার।
এএম ট্রেডিংয়ের নামে ১০৪ কোটি টাকা আত্মসাৎ
এই মামলায় জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে ভুয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স এএম ট্রেডিংয়ের নামে ১০৪ কোটি ২০ লাখ টাকার ঋণ অনুমোদন করে তা এস আলম সুপার এডিবল অয়েলে হস্তান্তর করা হয়। এর মধ্যে ৩৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে।
মামলার আসামিরা প্রায় একই, আগের মামলার মতো। শুধু আবদুস সামাদ লাবুর স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস ও ভাই আবদুল্লাহ হাসানের নাম বাদ গেছে। এতে আসামি করা হয়েছে ভুয়া প্রতিষ্ঠান মেসার্স এএম ট্রেডিংয়ের কথিত মালিক আলহাজ কবির আহম্মদকে।
সাইফুল অ্যান্ড কোম্পানির নাম দিয়ে ৭১ কোটি টাকা উধাও
দুদকের তৃতীয় মামলায় বলা হয়েছে, মেসার্স সাইফুল অ্যান্ড কোম্পানির নামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ঋণ নিয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৭১ কোটি ৫১ লাখ টাকা আত্মসাৎ এবং ২৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে।
এই মামলার প্রধান আসামিরা হলেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ, তার ভাই আবদুস সামাদ লাবু ও তার স্ত্রী শাহানা ফেরদৌস, ভাই আবদুল্লাহ হাসান, রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক এমডি বর্তমানে ভারতে অন্তরীণ প্রশান্ত কুমার (পিকে) হালদার ও তার বান্ধবী হিসেবে পরিচিত নাহিদা রুনাই। আসামি হয়েছেন রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের কর্মকর্তারা— রাশেদুল হক, কাজী আহমেদ জামাল, জুমারাতুল বান্না, জহির আহমেদ, টিপু সুলতান, মো. ইসহাক। এছাড়া আসামির তালিকায় নাম রয়েছে ভুয়া প্রতিষ্ঠান সাইফুল অ্যান্ড কোম্পানির কথিত মালিক সাইফুল ইসলামের।
দুদকের পর্যবেক্ষণ
দুদকের অভিযোগ, প্রতিটি মামলায় একই ধরনের কৌশলে ভুয়া প্রতিষ্ঠান তৈরি, জাল কাগজপত্র দাখিল এবং ঋণপ্রস্তাব অনুমোদনের পর একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করে আত্মসাৎ ও পাচার করা হয়েছে। দুদকের মতে, এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত দুর্নীতির চক্র, যা প্রতিটি ধাপে অত্যন্ত সংগঠিতভাবে পরিচালিত হয়েছে।
দুদক বলছে, এসব মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেজে/সিপি