মসলা খাইয়ে চট্টগ্রামে মশা মারার ছক আঁকছে সিটি কর্পোরেশন, আগ্রাবাদ দিয়ে শুরু

চট্টগ্রাম নগরে মশা মারার আগের সব ওষুধ বাদ দিয়ে এবার নতুন ওষুধ ছিটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। মসলাজাতীয় হারবাল উপাদানে তৈরি নতুন এই মশার ওষুধের নাম ‘মসকুবান’। আগ্রাবাদ দিয়ে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের সব ব্লকেই এই ওষুধ ছিটানো হবে। এরই মধ্যে কিছু মশা আক্রান্ত এলাকায় ভেষজ উদ্ভিদে তৈরি ওষুধটি ব্যবহার করে পাওয়া গেছে প্রত্যাশিত সাফল্য— এমন দাবি করেছে উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, ১ লিটার মসকুবানের সাথে ৫০ লিটার ন্যাপথা বা কেরোসিন মিশিয়ে এ ওষুধ স্প্রে করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। যদিও কৃষি অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব বিভাগ ও ইস্টার্ন রিফাইনারিতে এর গুণগতমান পরীক্ষার জন্য পাঠালেও এখনও ফলাফল হাতে পায়নি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সুপারিশপত্রের ওপর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরীক্ষামূলকভাবে নগরীর আগ্রাবাদে এটি স্প্রে করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ধারাবাহিকভাবে ৪১টি ওয়ার্ডের সব ব্লকেই মসকুবান ছিটানো হবে বলে জানিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান আবুল হাসেম। তিনি বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মসকুবান স্প্রের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।

আর এদিকে মসকুবান তৈরির উদ্ভাবক কেমিস্ট শ্যামল চৌধুরী দাবি করেছেন, হারবাল এই ওষুধ মশা মারতে শতভাগ কার্যকর। হাইজিয়া কনজ্যুমার প্রোডাক্টস বিডি লিমিটেড থেকে মসকুবান তৈরি করা হয় বলে জানান শ্যামল চৌধুরী।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান আবুল হাসেম বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করা হচ্ছে। স্প্রে ও ফগার মেশিন দিয়ে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে। কিন্তু কাজ না হওয়ায় আগের চেয়ে লোকবল বাড়ানো হয়েছে। আগে ১০৪ জন ছিল। এখন তা বেড়ে ২০৪ জন হয়েছে। এখন আমরা নতুন আর একটি ওষুধ মসকুবান স্প্রে করার চিন্তা করছি মশা নিধনের জন্য।

Yakub Group

তিনি বলেন, নালা-নর্দমা থেকে ডেঙ্গু হচ্ছে না। হচ্ছে জমানো পানি থেকে ডেঙ্গু। তাই জনসচেতনতা বাড়ানোর চেয়ে বড় কোন উপায় নেই এ মুহূর্তে।

জানা গেছে, ৪১টি ওয়ার্ডেই মশা মারার ওষুধ ছিটানো হয়। একটি ওয়ার্ডের ১০টি ব্লকে মশার ওষুধ ছিটানো হয়। একটা ব্লক শেষ হতে ৫ থেকে ৬ দিন সময় লাগে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন থেকে যে মশার ওষুধটি স্প্রে করা হয় সেটি টেমিফস ৫০ ইসি-লারভিসাইড, ইনভেন্ট –এডাল্টিসাইডও এলডিই (লাইট ডিজেল অয়েল)। কিন্তু এই ওষুধে মশা মরে না— এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

মসকুবান তৈরির উদ্ভাবক শ্যামল চৌধুরী বলেন, মসকুবান ১ লিটারের সাথে ৫০ লিটার ন্যাপথা বা কোরিসিন মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। প্রতি লিটারে মসকুবানের জন্য দাম পড়বে ভ্যাট ও আয়করসহ ১ হাজার ৩০০ টাকা। আর ন্যাপথা প্রতি লিটারে ভ্যাট ও আয়করসহ দাম পড়বে ৬৫ টাকা। ১০০ লিটার মসকুবানের সাথে ব্যবহার করতে হবে ৫১০০ লিটার ন্যাপথা।

এই হিসাব মসকুবানের জন্য হলেও বর্তমানে ব্যবহার করা ওষুধগুলোর জন্য এ অর্থবছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ব্যয় করেছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

মশা নিয়ন্ত্রণে বিষাক্ত ও নির্বিষ পদ্ধতির কথা বলতে গিয়ে শ্যামল চৌধুরী জানান, কিছু রাসায়নিক কীটনাশক মশা মারার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয় ঠিকই। তবে এগুলো মানুষ ও পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দীর্ঘমেয়াদী রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে ওইসব কীটনাশকের বিরুদ্ধে মশার দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে। যার ফলে এসব রাসায়নিক কীটনাশকগুলোকে মশা নিয়ন্ত্রণে অকার্যকর করে তোলে। এই ধরনের প্রতিরোধ বিশ্বব্যাপী মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই নিরাপদ জীবন ও পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য মশা নিয়ন্ত্রণে উদ্ভিদজাত উপাদান ভিত্তিক পণ্যগুলো এখন উৎসাহিত করা হচ্ছে। এই লক্ষ্যে মশা নিয়ন্ত্রণ আমাদের অ্যাডাল্টিসাইড এবং লার্ভিসাইড ওষুধটির উপাদানগুলো নির্বিষ উদ্ভিদের উপাদান দিয়ে তৈরি।

শ্যামল চৌধুরী দাবি করেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের গবেষণা এবং বাংলাদেশ কাউন্সিল ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর), ঢাকার ল্যাব টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, এই ভেষজ ওষুধটি উড়ন্ত প্রাপ্তবয়স্ক মশা এবং লার্ভা ধ্বংসে শতভাগ কার্যকর।

তিনি আরও বলেন, সব কীটনাশকই বিষ। কিছু কীটনাশক সাধারণত মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহার করা হয়। এই কীটনাশকগুলোর ব্যবসায়িক নামগুলো হল স্কার্জ, অ্যানভিল এবং পারমেথ্রিন। পাইরেথ্রয়েড (সিন্থেটিক) শ্রেণির কীটনাশকগুলো স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে— লিভার ও থাইরয়েড সমস্যার সাথে যুক্ত।

তিনি বলেন, তার তৈরি মসকুবানের উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে নিমের তেল। নিমের তেল হল একটি উদ্ভিজ্জ তেল— যা নিমের ফল এবং বীজ থেকে বের করা হয়। সবচেয়ে বহুমুখী কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের সামগ্রীর মধ্যে একটি হল নিম তেল। নিমের তেল ছোট নরম দেহের কীটপতঙ্গ মেরে ফেলে। এটি কীটপতঙ্গের হরমোন ক্ষরণে ব্যাঘাত ঘটায় এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক হিসাবেও কাজ করে। লবঙ্গ তেলের দুটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই তেল মশার বিরুদ্ধে (বিতাড়িত করতে) বেশ সক্রিয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মশলাজাতীয় এই তেল প্রায় চার ঘন্টা কার্যকর। গবেষণায় খাইম বা আজৈনের তেলের উল্লেখযোগ্য মশা প্রতিরোধক বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে। নির্দিষ্ট ঘনত্বে নির্দিষ্ট মশার প্রজাতির বিরুদ্ধে এটি বেশি কার্যকর। তুলসী তেলও তার মধ্যে রয়েছে। রয়েছে লং, এলাচের মত মসলাও। এসব তেলের সাথে এর ৫০ থেকে ৬০ গুণ বেশি পরিমাণে কেরোসিন, ডিজেল, ন্যাফথা বা অন্যান্য পাতলা পেট্রোলিয়াম/মিনারেল অয়েল মিশিয়ে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে বা সরাসরি স্প্রে করলে কৃত্রিম বিষাক্ত অ্যাডাল্টিসাইড এবং লার্ভিসাইডের চেয়ে মশা এবং লার্ভা আরও দ্রুত মারতে সক্ষম। এই উদ্ভিদজাত তেলের মানুষের শরীর এবং পরিবেশের উপর কোন বিরূপ প্রভাব নেই।

তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কিছু মশা আক্রান্ত এলাকায় আমাদের ভেষজ উদ্ভিদ ভিত্তিক অ্যাডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড ঔষুধটি ব্যবহার করে প্রত্যাশিত সাফল্যের পর মেয়রকে জানানো হয়।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রচলিত বিষাক্ত কীটনাশকগুলো ব্যবহার করে মশা নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ওই কীটনাশকগুলো ছাড়াও নতুন ভেষজ ওষুধটি পরীক্ষার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান।

এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাভূক্ত ৯৯টি স্থান পরিদর্শন করে ৩৩টি স্থানে এডিস মশার লার্ভা, ৩৯টি স্থানে এনোফিলিস মশার লার্ভা এবং ২২টি স্থানে উভয় প্রকার লার্ভার খোঁজ পায়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলটি সংগৃহীত লার্ভাগুলো লালন-পালন করে পূর্ণাঙ্গ বয়ষ্ক মশায় রূপান্তর করে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। গবেষকদলের দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রচলিত বিষাক্ত কীটনাশক স্প্রে এবং ফগিং (ধোঁয়া হিসেবে ছড়ানো) সামান্য কার্যকর এবং মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে প্রাকৃতিক ভেষজ উপাদানে তৈরি ‘মসকুবান’ ওষুধটি শতভাগ কার্যকর।

সিনিয়র অধ্যাপকদের এই গবেষণা প্রতিবেদনটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সিটি মেয়রের কাছে হস্তান্তর করেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm