সাতকানিয়ার মিন্টুবাহিনী মিথ্যা মামলার জালে ফেলে প্রতিপক্ষ ঘায়েলের চেষ্টায়

মামলার ভিত্তিই খুঁজে পাচ্ছে না থানা ও তদন্ত সংস্থা

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়ায় মিন্টু বাহিনীর দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, দখলবাজি, দিনেদুপুরে মাস্তানির পর এবার মামলাবাজিতে নেমেছে ওই বাহিনীর সাঙ্গপাঙ্গরা। প্রতিবাদকারীদের ঘায়েল করতে একের পর এক মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এলাকার সাধারণ মানুষও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

এলাকা ঘুরে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে ফখরুদ্দিন মিন্টু বাহিনীর ক্যাডারদের কাছে জিম্মি থাকা পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা গ্রামের কিছু মানুষ সম্প্রতি তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। এ নিয়ে মিন্টু বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়। এর মধ্যে প্রতিবাদকারী একজনের বাড়িতে গুলি করে হত্যা চেষ্টা, অতর্কিত হামলা, বাড়ি থেকে বের হতে না দেওয়া, প্রকাশ্যে গালাগাল করা ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। এমনকি মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকিসহ হয়রানিমূলক নানা কর্মকাণ্ডও চলছে বারবার। এরই অংশ হিসেবে মিন্টুর সাঙ্গপাঙ্গরা তিনটি মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা দায়ের করেছে ইতিমধ্যে। স্থানীয়রা বলছেন, প্রবাস থেকে মিন্টু হুমকি দিচ্ছেন আরও অনেক মামলা করানো হবে।

ইতিমধ্যে রেজাউল করিম সুজন নামের এক লোক বাদি হয়ে আদালতে মিথ্যা চাঁদাবাজির মামলা করেছেন জাফর আহমদ ভুট্টো, আবদুল আজিজ, মো. মহিউদ্দিন, শাকিল আহম্মদ, শাহেদ আহম্মদ ও মো. এমরানের বিরুদ্ধে। এছাড়া মিন্টু বাহিনীর সন্ত্রাসী ফারুক ওরফে টাইগার ফারুক বাদি হয়ে করেছে আরও একটি মামলা। ১৪ আগস্ট গভীর রাত বাড়িতে গুলি করে হত্যার চেষ্টায় নলুয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি মো. মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ টাকা মানহানির ওই মামলা করা হয় আদালতে।

স্থানীয়রা জানান, মিন্টু বাহিনীর আরেক ক্যাডার অস্ত্র মামলার আসামি রিয়াদের মা জাহানারা বেগম বাদি হয়ে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে আরও একটি মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বানোয়াট মামলা করেন আদালতে। ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে মো. মহিউদ্দিন, জাফর আহম্মদ ভুট্টো, শাহেদ আহম্মদ ও এমরানকে। আদালত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধর্ষণ চেষ্টা মামলায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা পরস্পরের মামাত-ফুফাত ভাই। মামলায় ঘটনার আশপাশের কোনো সাক্ষীও নেই। সাক্ষী হয়েছেন সন্ত্রাসী ফারুকের ভাই নুরুল আমিন, মো. জাবেদ ও ছেলে রিয়াজ। সাক্ষী নুরুল আমিন ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়ে জামিনে আছেন। মো. জাবেদ প্রবাসফেরত বেকার। তিনি মিন্টু বাহিনীর করা তিন মামলারই সাক্ষী। জাবেদকে টাকার বিনিময়ে এসব মামলার বানানো সাক্ষী হয়েছেন বলে অভিযোগ বিবাদি পক্ষের। তাছাড়া সাক্ষীদের বাড়ি বাদিনীর বাড়ি ঘটনাস্থালের আশেপাশে নয়। বিবাদি এমরান চাকরি করেন সীতাকুণ্ড একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ঘটনার দিন তিনি এলাকায়ও ছিলেন না। অন্যান্য বিবাদিরাও মামলায় উল্লেখ করা ঘটনাস্থলে ছিলেন না ওইদিন। বিষয়টি ইতিমধ্যে তদন্তকারী সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে প্রযুক্তির সাহায্যে।

Yakub Group

এদিকে আদালত অপর দুই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন সাতকানিয়া থানা পুলিশকে। থানা পুলিশও তদন্তে মামলায় উল্লেখ করা ওইসব ঘটনার সত্যতা পায়নি বলে জানা গেছে। রেজাউল করিম সুজনের করা মামলায় বিবাদিদের বাড়ি পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা হলেও ঠিকানা লেখা হয়েছে পশ্চিম গাটিয়াডেঙ্গা— যা ডলু নদীর ওপারে পার্শ্ববর্তী এওচিয়া ইউনিয়নের অধীন। চিহ্নিত সন্ত্রাসী ফারুকের মানহানি মামলায় যে ফারুক স্টোরের মালিক বলে দাবি করা হয়েছে এমন কোনো দোকানের অস্তিত্বই নেই এলাকায়।

স্থানীয় ও বিবাদি পক্ষের অভিযোগ, মিন্টু দেশের বাইরে থাকলেও এসব মামলা ও ঘটনা হচ্ছে তার সরাসরি ইন্ধন, নির্দেশনা ও অর্থায়নে। দেশে তার হয়ে এক বিশ্বস্ত অনুগত এসব মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক মামলা দায়ের ও তদারকি করছেন। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ওই ব্যক্তি মূলত ধর্ষণ চেষ্টা মামলায় বাদিসহ সাক্ষীদের পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে সাক্ষী করিয়ে নেন। তদন্ত কর্মকর্তা তার অত্যধিক তৎপরতা দেখে সাক্ষী হওয়ার জন্য বললেও তিনি রাজি হননি। তবে পিবিআইয়ের ওই কর্মকর্তা কৌশলে তার নাম ও মোবাইল নাম্বার নিয়ে রাখেন। ওই লোক নিজেকে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী বলেও মিথ্যা পরিচয় দেন পিবিআই কর্মকর্তার কাছে। এসব তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে।

সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তারেক মো. আবদুল হান্নান এ প্রসঙ্গে বলেন, নলুয়ার পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা এলাকায় প্রবাসী মিন্টু ও কামাল— এই দুই ভাইয়ের ছত্রচ্ছায়ায় একটি সন্ত্রাসী বাহিনী রয়েছে। ওই বাহিনীর সদস্যরা পুরো এলাকা সন্ত্রাসী কার্যকলাপের মাধ্যমে অশান্ত করে রেখেছে। এলাকার সাধারণ মানুষ তাদের কাছে জিম্মি। প্রশাসন এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে। ইতিমধ্যে সন্ত্রাসী ফারুককে গ্রেফতার করা হয়েছে একাধিকবার। সে জেল থেকে বেরিয়ে এসেই চুরি, ডাকাতি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন ফারুক, মোরশেদ, জামশেদ, জোবায়েরসহ ওই সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। এখন মিন্টু কামালের সাঙ্গপাঙ্গরা বিভিন্ন বাহানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করছে আদালতে। তদন্তে এসব মামলায় উল্লেখ করা কোনো ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নি।

এদিকে স্থানীয়দের অভিযোগ, ফারুককে দিয়েই মিন্টু বাহিনী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করার অপচেষ্টা করছে। বিভিন্ন মামলায় ফারুক গ্রেপ্তার হলেও মিন্টুর সাঙ্গপাঙ্গদের চেষ্টা তদবিরে তাকে ছাড়িয়ে আনে জেল থেকে। ফারুকও ছাড়া পেয়ে মিন্টুর নির্দেশে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে আবার। হাত কাটা হবে, মেরে ফেলা হবে, তুলে নেওয়া হবে, অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের বাড়ি ঘরে হামলা করা হবে— এমন সব ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সর্বশেষ জেল থেকে জামিনে এসে ফারুক বাদিকে ‘মামলা তুলে না নিলে দেখে নেবে’ বলে হুমকি দিচ্ছে। তাই বাদি জহির উদ্দিন এ ব্যাপারে সাতকানিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। জিডিতে উল্লেখ করা হয়, মামলা তুলে নেওয়ার জন্য ফারুক বিভিন্নভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। না হয় জহিরের ক্ষতি করা হবে। এমনকি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ভুক্তভোগী জহির উদ্দিন বলেন, ‘আমি এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিনাতিপাত করছি। আমার স্ত্রী ও সন্তানরা সন্ত্রাসী ফারুকের কাছে জিম্মি। প্রাণের ভয়ে তারা ফারুকের কবল থেকে বের হতে পারছে না। তার কথার ক্রীড়ানক হয়ে আছে। আমাকেও প্রাণে মারা হবে, একাধিক মামলা করা হবে— আমার বিরুদ্ধে ক্রমাগত এমন হুমকি দেওয়া হচ্ছে। থানায় জিডির মাধ্যমে তা পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm