হাজরে আসওয়াদ থেকে মাকামে ইব্রাহিম: কাবার পবিত্র কোণগুলোর মাহাত্ম্য ও ফজিলত

মক্কা মুকাররমার হৃদয়ে অবস্থিত পবিত্র কাবা শরিফ মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ স্থান। এই কাবা শরিফের প্রতিটি অংশই ইসলামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। বিশেষ করে কাবা শরিফের চারটি কোণ বা রোকন, হাজরে আসওয়াদ এবং মাকামে ইব্রাহিমের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত।

কাবা শরিফের চার রোকনের পরিচয় ও মর্যাদা

পবিত্র কাবা শরিফের চারটি কোণকে রোকন বলা হয়। প্রতিটি রোকনের রয়েছে আলাদা নাম ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য। প্রথম রোকন হলো রোকনে হাজরে আসওয়াদ, যা কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত। এই রোকন থেকেই তাওয়াফ শুরু করা হয় এবং এটি সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ রোকন। দ্বিতীয় রোকন হলো রোকনে ইরাকি, যা উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। তৃতীয় রোকন হলো রোকনে শামি, যা উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। চতুর্থ রোকন হলো রোকনে ইয়ামেনি, যা দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত।

রোকনে ইরাকি ও রোকনে শামির মধ্যবর্তী স্থানে হাতিমে কাবা অবস্থিত, যা একসময় কাবা শরিফেরই অংশ ছিল বলে জানা যায়। তাওয়াফের সময় রোকনে ইয়ামেনি স্পর্শ করা এবং রোকনে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা সুন্নাত। নবী করিম (সা.) বলেছেন, “হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম জান্নাতের দুটি ইয়াকুত পাথর। আল্লাহ এগুলোর মধ্যে নূর মিশ্রিত করেছেন।” (তিরমিজি)

হাজরে আসওয়াদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও ফজিলত

হাজরে আসওয়াদ কাবা শরিফের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফ থেকে প্রায় দেড় মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এই কালো পাথরটি আদম (আ.)-এর সময় থেকে পৃথিবীতে রয়েছে বলে ইসলামী বিশ্বাস। হাদিসে বর্ণিত আছে, এটি প্রথমে ছিল ধবধবে সাদা, কিন্তু মানুষের গুনাহের কারণে কালো হয়ে গেছে। (তিরমিজি)

ইতিহাস থেকে জানা যায়, হাজরে আসওয়াদ মূলত একটি সম্পূর্ণ পাথর ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বর্তমানে এটি রূপার ফ্রেমে সংরক্ষিত আছে এবং এর আটটি টুকরা দেখা যায়। প্রতিটি হজ ও উমরা পালনকারীর জন্য হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করা বা ইশারা করা সুন্নাত।

মাকামে ইব্রাহিমের ঐতিহাসিক তাৎপর্য

কাবা শরিফের পাশেই ক্রিস্টালের বাক্সে সংরক্ষিত রয়েছে মাকামে ইব্রাহিম। এটি একটি বর্গাকৃতির পাথর, যার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও উচ্চতা প্রায় এক হাত সমান। এই পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে হজরত ইব্রাহিম (আ.) কাবা শরিফ নির্মাণ করেছিলেন বলে ইসলামী ইতিহাসে বর্ণিত আছে। পাথরটিতে তাঁর পায়ের ছাপ আজও বিদ্যমান।

মাকামে ইব্রাহিমের বিশেষ ফজিলত হলো যে এখানে দোয়া কবুল হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা মাকামে ইব্রাহিমকে নামাজের স্থান হিসাবে গ্রহণ করো।” (সুরা বাকারা: ১২৫) তাওয়াফ শেষে এখানে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নাত। হজ ও উমরা পালনকারীরা এখানে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।

রোকনে ইয়ামেনির বিশেষত্ব

রোকনে ইয়ামেনি কাবা শরিফের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। এই রোকন স্পর্শ করা সুন্নাত, তবে চুম্বন করা হয় না। নবীজি (সা.) বলেছেন, “রোকনে ইয়ামেনি ও হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করলে গুনাহ মাফ হয়।” এই দুই রোকনের মধ্যবর্তী স্থানে একটি বিশেষ দোয়া পড়ারও নির্দেশনা রয়েছে।

ইসলামী ঐক্যের প্রতীক

হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম শুধু পাথর নয়, বরং ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। এখানে সব মুসলমান ধনী-দরিদ্র, কালো-সাদা, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে একত্রিত হয়। নবীজি (সা.)-এর সময় কাবা পুনর্নির্মাণের সময় কুরাইশদের মধ্যে বিবাদ নিষ্পত্তির ঘটনা ইসলামী ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

পরিশেষে

পবিত্র কাবা শরিফের এই সকল নিদর্শনগুলো মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম স্পর্শ করা শুধু একটি রীতি নয়, বরং ইমান ও ইতিহাসের সাথে সম্পর্কযুক্ত আমল। আল্লাহ আমাদেরকে এই পবিত্র স্থানগুলোর বরকত লাভের তাওফিক দান করুন এবং আমাদেরকে সঠিকভাবে হজ ও উমরা পালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm